E-Paper

নরম-গরম

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যুক্তিই হল, মুসলমানরা অধিকসংখ্যক সন্তান উৎপাদন করে জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে; তা ঠেকানোর দু’টি পথ: মুসলমান খেদানো, এবং হিন্দুদের সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪২

এই কথাটা অস্বীকার করার উপায়মাত্র নেই যে, হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রের অন্য নেতাদের সঙ্গে তুলনা করলে মোহন ভাগবতকে ধর্মনিরপেক্ষ সহিষ্ণুতার ‘পোস্টারবয়’ মনে হতে থাকে। এই যেমন, অমিত শাহ যেখানে কোনও তথ্যপ্রমাণের তোয়াক্কা না করেই বলে দিলেন যে, ভারতের পূর্বপ্রান্তের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে গিয়েছে; সেখানে দিল্লিতে তিন দিনব্যাপী বক্তৃতামালার শেষ দিনে ভাগবত বললেন, সব ভারতবাসীরই তিনটি করে সন্তানের জন্ম দেওয়া উচিত। তিনটি, কারণ জন্মহারের রিপ্লেসমেন্ট রেট হল প্রত্যেক নারীপিছু ২.১টি সন্তান। ভাগবতের যুক্তিটি সারল্যে ভরপুর— বললেন, ০.১টি সন্তান আবার হয় নাকি! ২.১ মানেই তিন। নাগপুরের পাঠশালায় সম্ভবত গড়ের অঙ্ক শেখানো হয় না; অথবা, দশমিকে থাকা সংখ্যাকে কী ভাবে ‘রাউন্ড অফ’ করা হয়, সে কথাও ছাত্রদের জানানো হয় না। কিন্তু, লক্ষণীয়, ভাগবতের তিন সন্তান নীতি ‘সব ভারতীয়’র জন্য। গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা যে শুধু হিন্দুদের চারটি করে সন্তান উৎপাদনের নিদান দিতে অভ্যস্ত, ভাগবতের পরামর্শ অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তার চেয়ে পৃথক। বস্তুত, জনসংখ্যা নিয়ে তাঁর এই অবস্থানটিই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘোষিত অবস্থানের চেয়ে আলাদা— এই বক্তৃতায় তিনি ভারতের জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসাবে দেখেননি, বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি কমাকেই দুশ্চিন্তার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, ভাগবত বুঝি সত্যিই গোটা দেশের কথা ভাবছেন।

সম্ভবত, তিনি তা-ই ভাবছেন। তবে আশঙ্কা হয়, তাঁর কল্পনার ভারতের বৈধ নাগরিক হিসাবে তিনি শুধু হিন্দুদেরই দেখেন। কারণ, তাঁর বক্তৃতাতেই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, হিন্দুদের মধ্যেই সন্তানপ্রসবের হার কমেছে সবচেয়ে দ্রুত; অন্যদের ক্ষেত্রেও কমেছে বটে, কিন্তু ততখানি নয়। অর্থাৎ, উদারতার মিহি আস্তরণটি সরালেই ভাগবতের বক্তৃতাতেও স্পষ্ট হবে হিন্দুদের প্রতি সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধির আহ্বান। ‘জনসংখ্যার ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয়’— অর্থাৎ, জনসংখ্যায় যাতে হিন্দুর অনুপাত তিলমাত্র না কমে, তার জন্যই এই ডাক। ফারাক হল, অন্য নেতারা হিন্দুদের চারটি করে সন্তান উৎপাদনের আহ্বান জানান— কারণ, হিন্দুত্ববাদীদের প্রচলিত বিশ্বাস, প্রত্যেক মুসলমানের অন্তত চারটি সন্তান, যদিও এই বিশ্বাসের কোনও পরিসংখ্যানগত ভিত্তি নেই। অনুমান করা চলে, হিন্দুত্ববাদের পরিসরে অমিত শাহ বা আদিত্যনাথ এখন ‘রাগী পুলিশ’; তাই ভাগবত ‘ভাল পুলিশ’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। লক্ষণীয়, জন্মহার, জনসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে সমগ্র বাগ্‌বিস্তারে ভাগবত এক বারও বলেননি যে, কেরলে মুসলমানদের জন্মহারের চেয়ে উত্তরপ্রদেশে হিন্দুদের জন্মহার বেশি। কথাটি তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই চেপে যেতে চান। কারণ, জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা যতই বলুন যে, জন্মহার ধর্মের উপরে নির্ভর করে না, করে উন্নয়নের অন্য একাধিক মাপকাঠির উপরে— হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যুক্তিই হল, মুসলমানরা অধিকসংখ্যক সন্তান উৎপাদন করে জনসংখ্যার বিন্যাস পাল্টে দিচ্ছে; তা ঠেকানোর দু’টি পথ: মুসলমান খেদানো, এবং হিন্দুদের সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি। ভাগবতও রাজনীতির এই চেনা ছকটিই বজায় রেখেছেন তাঁর ভাষণে।

গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের কাছে যে কোনও প্রশ্নই বিদ্বিষ্ট রাজনীতির। তার সবচেয়ে বড় বিপদ হল, প্রশ্নটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্র রাজনীতির হয়ে উঠলে তার সম্বন্ধে অন্য আলোচনাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। দেশে জনসংখ্যার সামগ্রিক বিন্যাস, আঞ্চলিক তারতম্য, উন্নয়নের বিবিধ সূচকের সঙ্গে জনসংখ্যার বিন্যাসের সম্পর্ক— যে প্রশ্নগুলি নিয়ে প্রকৃতই আলোচনার প্রয়োজন, যে প্রশ্নগুলির ভারতের উন্নয়ননীতির আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে ওঠার কথা, সেগুলি ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। অমিত শাহর গরম, এবং মোহন ভাগবতের নরম অবস্থান আসলে একই হিন্দুত্ববাদী মুদ্রার দুই পিঠ। এবং, সেই মুদ্রাটি ভারতকে ক্রমেই অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RSS

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy