E-Paper

পদক্ষেপ জরুরি

বিনা অপরাধে এবং তথ্যপ্রমাণহীন ভাবে বাঙালি পরিযায়ীদের এমন হেনস্থা অন্য প্রদেশের সরকারের তত্ত্বাবধানেই ঘটছে, সুতরাং তা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই গুরুত্বসহকারে সঙ্কট সমাধানের পথে এগোতে হবে।

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৬

বাঙালি অর্থাৎ বাংলাদেশি: এই সরল সমীকরণের উপর ভিত্তি করে দেশের অন্যান্য প্রদেশ থেকে পরিযায়ী পশ্চিমবঙ্গীয়দের বিতাড়ন, এবং সীমান্তের ওপারে বহিষ্কার— ইতিমধ্যেই একটি বিরাট সঙ্কটের রূপ নিয়েছে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে এতখানি বিরূপতা ও আক্রমণ কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, অতীব বিপজ্জনক। এ বিষয়ে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক সচেতনতার প্রসার ও প্রচার এখনই অতি জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে: সংবাদে প্রকাশ। সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে কাজ করতে যাওয়া ফজ়ের মণ্ডলকে সপরিবার বাংলাদেশে নিক্ষেপ করে মহারাষ্ট্র পুলিশ। সেই খবরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করাতে বিষয়টির সুরাহা হয়, প্রশাসনের সহযোগিতায় রায়গঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আবার ভারতে ফিরিয়ে আনা যায় এই পরিবারটিকে। একই ভাবে, ওড়িশায় কাজ করতে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু শ্রমিককে সে রাজ্যের পুলিশ আটক করায় তাঁদের ছাড়ানোর জন্যও রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই কি এই ভাবে উচ্চতম মহলের হস্তক্ষেপ সম্ভব? এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গীয় পরিযায়ীদের পরিস্থিতি কতটা অসহায়, তা মাথায় রেখে জরুরি ভিত্তিতে কেন্দ্রের সহায়তা দরকার। বিনা অপরাধে এবং তথ্যপ্রমাণহীন ভাবে বাঙালি পরিযায়ীদের এমন হেনস্থা অন্য প্রদেশের সরকারের তত্ত্বাবধানেই ঘটছে, সুতরাং তা বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকেই গুরুত্বসহকারে সঙ্কট সমাধানের পথে এগোতে হবে।

বস্তুত, সঙ্কটটি আকারে বিশাল। এ কেবল প্রশাসনিক অতিসক্রিয়তা নয়, সামাজিক ভাবেই এই বাঙালি শ্রমিকরা বয়কট ও আক্রমণের মুখে পড়েছেন। এঁরা সংখ্যালঘু— ধর্মপরিচয়ে মুসলমান— বলেই যে এঁদের বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। লক্ষণীয়, পশ্চিমবঙ্গের বিরাট মুসলমান জনসমাজের এক বড় অংশ গত সাড়ে সাত দশক ধরেই অন্য প্রদেশে কর্মসূত্রে পরিযাণ করে থাকেন। তার একটি কারণ যদি হয় তাঁদের তুলনামূলক পশ্চাৎপদ অবস্থান এবং দারিদ্র, অন্য কারণটি— বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁদের ঐতিহ্যগত দক্ষতা। যেমন জরির কাজ বা মূল্যবান অলঙ্কার নির্মাণের কাজে বাঙালি মুসলমান শ্রমিকের দক্ষতা বহু দশক ধরে খ্যাত, বিভিন্ন প্রদেশে তাঁরা এই সব কাজে যোগ দিয়ে আসছেন স্বাধীনতারও আগে থেকেই। অথচ গত কয়েক মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁরা ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছেন, বাংলাদেশি সন্দেহে কেবল তাঁদের বিতাড়ন নয়, তাঁদের উপর নির্যাতনও শুরু হয়েছে। এমনকি ভারতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করলেও তাঁরা রেহাই পাচ্ছেন না। এই সুপরিব্যাপ্ত সামাজিক সঙ্কটের জন্য প্রকৃত দায়িত্ব যে সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির লাগাতার সংখ্যালঘুবিরোধী প্রচার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতীয় গণতন্ত্র আজ বিদ্বেষবিষে এমনই আক্রান্ত ও আকীর্ণ যে কোনও যুক্তি, তথ্য, নথিপরিচিতি, কিছুই আজ সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয়।

সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনা বাঙালি মুসলমানের প্রতি এই ভিত্তিহীন বিদ্বেষকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম, অপারেশন সিঁদুর। দ্বিতীয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল ও সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব। ফলত, বাংলাদেশি মুসলমান মানেই ভারতের শত্রু, এবং বাংলাভাষী মুসলমান মানেই বাংলাদেশি, এই দুই ভ্রান্ত সমীকরণ জনমানসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এই সামাজিক বিষক্রিয়া ঘটিয়েছেন যে রাজনীতির কারবারিরা, তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে আগুন লাগলে দেবালয়ও অক্ষত থাকে না। পশ্চিমবঙ্গেও অন্যান্য রাজ্য থেকে ভিনসংস্কৃতির মানুষরা এসে কাজ করেন, সমগ্র ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রেই শ্রমিক পরিযাণ প্রথা চলে আসছে। এর কোনও একটি অংশ তীব্র হিংসার বিষে বিষিয়ে গেলে অন্যত্রও তা ছড়াতে পারে। এই ভয়ানক পরিস্থিতির আশু সমাধান জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali India Government Migrant West Bengal Minority

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy