কথা শোনে না, তাই টাকা দেব না— এমনকি তা প্রাপ্য, হকের টাকা হলেও না। বাড়ির একরোখা, প্রতিবাদী সন্তানকে ‘শিক্ষা’ দিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিভাবকের এ-হেন মনোভাব গল্পে-উপন্যাসে কি সিনেমায় যদি বা মানা যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় একেবারেই বেমানান। কিন্তু ঠিক সেই আচরণই কেন্দ্র সম্প্রতি করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও তামিলনাড়ুর সঙ্গে। লোকসভায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া সরকারি তথ্যই জানাচ্ছে, পিএমশ্রী খাতে ও সমগ্র শিক্ষা অভিযান যোজনায় ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের একটি পয়সাও পায়নি পশ্চিমবঙ্গ; একই দশা কেরলেরও। অথচ একই সময়ে গুজরাত অসম বিহারের মতো রাজ্য কেন্দ্রের বরাদ্দ অর্থ পেয়েছে প্রচুর। কারণটি স্পষ্ট: কেন্দ্রীয় বরাদ্দ-বঞ্চিত রাজ্যগুলি জাতীয় শিক্ষানীতি মানেনি বা স্কুলে চালু করেনি, পিএমশ্রী-স্কুলের জন্য কেন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করেনি। গত মার্চেই এ নিয়ে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট বলেছিল, কেন্দ্রের এই আচরণ অন্যায্য, অবিলম্বে বঞ্চিত রাজ্যগুলির প্রাপ্য অর্থ তাদের দেওয়া হোক। তা যে হয়নি, সরকারি তথ্যেই পরিষ্কার।
অর্থাৎ দিনের শেষে কথাটা এই: যে রাজ্য কেন্দ্রের ফরমান মানবে না, তাকে বরাদ্দ অর্থও দেওয়া হবে না। সোজা কথায়, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য অর্থ-বরাদ্দ পাবে না, বিজেপি-শাসিত রাজ্য পাবে। এ অতি দুর্ভাগ্যের যে বিরোধী রাজ্যগুলিকে ‘শিক্ষা দিতে’ কেন্দ্র বেছে নিয়েছে স্কুলশিক্ষার মতো ক্ষেত্র: সমগ্র শিক্ষা অভিযানের বরাদ্দ অর্থ স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত করতে, শিক্ষকদের মাইনে ও প্রশিক্ষণ দিতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের পরিবহণের মতো জরুরি কাজে ব্যয়িত হয়, কেন্দ্রের তা অজানা নয়। শিক্ষা এক মৌলিক অধিকার, ভারতের মতো বিরাট দেশে কোটি কোটি স্কুলপড়ুয়ার বনিয়াদি শিক্ষাটুকুও নিশ্চিত করতে হলে যে পরিকাঠামো দরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্র-রাজ্যের মিলিত উদ্যোগ ছাড়া তা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক বিরোধিতা কোনও উন্নয়নের কাজে কাঁটা হতে পারে না, সেই উন্নয়ন স্কুলশিক্ষাকেন্দ্রিক হলে তো কখনওই নয়। তামিলনাড়ু জাতীয় শিক্ষানীতির ত্রিভাষা-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সরব বলে, বা পশ্চিমবঙ্গ স্কুলব্যবস্থায় জাতীয় শিক্ষানীতি মানেনি বলে তাদের প্রাপ্য বরাদ্দ আটকে দেওয়ার একমাত্র ব্যাখ্যা তাই কেন্দ্রের প্রতিশোধস্পৃহা, অ-বিজেপি রাজ্যকে হাতে না পেরে ভাতে মারতে চাওয়ার অভিসন্ধি।
বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য ভাবে করলে সমগ্র শিক্ষা যোজনার বরাদ্দ-সহ সব কেন্দ্রীয় সুবিধা পাবে। এই যুক্তি সম্পূর্ণ অন্যায্য। সমগ্র শিক্ষা যোজনার মূলে আছে শিক্ষার অধিকার আইন, এই আইনমতে দেশের সব শিশু যাতে শিক্ষার অধিকার পায় তা নিশ্চিত করাই ওই প্রকল্পটির কাজ, যে কাজে রাজ্যগুলিকে যার যার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে সব রকম সাহায্য করা কেন্দ্রের নিঃশর্ত কর্তব্য। জাতীয় শিক্ষানীতি বা পিএমশ্রী’র দোহাই দিয়ে এখানে শিক্ষার অধিকার ও তৎসংক্রান্ত উন্নয়নের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া চলবে না— কেন্দ্র যা করে চলেছে। শিক্ষা-দুর্নীতির পাঁকে পড়েও পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষায় ‘গ্রোস এনরোলমেন্ট রেশিয়ো’ জাতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। রাজনীতি-দুষ্ট অসহযোগের বিপথ ছেড়ে কেন্দ্র আসল পথে আসুক— শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন নিয়ে কোনও হেলাফেলা নয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)