Advertisement
১১ মে ২০২৪
Massachusetts Institute of Technology

ভাষা

তাহার প্রেরিত সঙ্কেত অপর একটি যন্ত্র গ্রহণ করিয়া ইমেল পাঠাইবে বিজ্ঞানীদের।

— ছবি সংগৃহীত

— ছবি সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:২৬
Share: Save:

কবি বলিয়াছিলেন বটে ‘ফুলগুলি যেন কথা,’ তাহা বলিয়া পালং শাক ইমেল পাঠাইবে, এতটা হয়তো কল্পনা করেন নাই। এখন তাহাই জলভাত— অথবা শাকভাত। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানীদের নিয়মিত ইমেল করিতেছে পালং। চমকপ্রদ এই গবেষণাটি সফল হইয়াছিল ২০১৬ সালে, কিন্তু তাহার পূর্ণ বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে। উদ্ভিদ তাহার শিকড় দিয়া জলের সহিত নানা প্রকার রাসায়নিকও গ্রহণ করে। রাসায়নিক-মিশ্রিত জল পাঠাইয়া দেয় পাতায়। পালং শাকের উপর বিজ্ঞানীরা বসাইয়াছেন এমন ‘ন্যানোপার্টিকল’, যাহা ল্যান্ডমাইনে ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলি চিনিতে পারিবে। তাহার প্রেরিত সঙ্কেত অপর একটি যন্ত্র গ্রহণ করিয়া ইমেল পাঠাইবে বিজ্ঞানীদের। নিরীহ পালং এমন গোয়েন্দাগিরি করিতে পারে, কে জানিত? বিজ্ঞানীরা বলিয়াছেন, রাসায়নিক বিশ্লেষণের ক্ষমতা উদ্ভিদের এতই প্রখর যে, তাহাদের বার্তা ধরিতে পারিলে খরার আগাম বার্তা মিলিতে পারে, নির্ণীত হইতে পারে দূষণ। এই সংবাদ চমৎকৃত করিয়াছে বিশ্বকে। নানা রসিকতা বর্ষণ হইতেছে। কেহ দাবি করিয়াছেন, বেশ কিছু ‘স্প্যাম’ বার্তা পড়িয়া তাঁহারা আগেই সন্দেহ করিয়াছিলেন, সেগুলি পালং-ই পাঠাইয়াছে, মানুষ নহে। কেহ ছদ্ম-হতাশায় বলিয়াছেন, পালং-ও ইমেল পাঠাইতে শিখিল, মাতৃদেবী আজও শিখিলেন না! এমন লঘু আমোদের সহিত যোগ হইয়াছে এক গভীর বিস্ময়ও। উদ্ভিদ ও মানব, বসুন্ধরার কোলে দুইটি প্রজাতি পাশাপাশি বাস করিয়াছে, কিন্তু পরস্পরের ভাষা বোঝে নাই। অন্তত, মনুষ্যজাতির তরফে সেই খামতি থাকিয়াই গিয়াছে। এই বার কি মানুষ উদ্ভিদের ভাষা বুঝিতে শিখিবে?

তবে, প্রশ্ন হইল, এত দিন কি সত্যই বোঝে নাই? বাতাস বহিয়া গেলে যে মর্মরধ্বনি উঠে পাতায় পাতায়, তাহা কি মানবসন্তানের মনে ঢেউ তোলে নাই? প্রফুল্ল কদম্ববন, মুকুলিত আম্রকানন যে কথা না কহিয়াও বাঙ্ময়, এই সত্য অনুভব না করিলে এত কাব্য, এত সঙ্গীত কি উচ্ছ্বসিত হইত? এ কথা সত্য যে, মানুষ তাহার স্বভাবজ কল্পনাশক্তি দিয়া উদ্ভিদজগতের ‘ভাষা’ শুনিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতির রহস্য আরও গভীর। গত কয়েক দশকে বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার সাহায্যে উদ্ভিদের ‘ভাষা’ বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহার ফলাফল যত প্রকাশিত হইতেছে, ততই বিস্ময়ে শিহরিত হইতেছে মানবকুল। উদ্ভিদ মানুষেরই মতো সমাজবদ্ধ জীব— পরস্পর নির্ভরতার এক নিবিড় বন্ধনের জন্যই উদ্ভিদের প্রাণরক্ষা ও বংশবৃদ্ধি সম্ভব হইতেছে। তাহাদের একে অপরের সহিত সংযোগের প্রধান উপায় বিবিধ রাসায়নিক। পতঙ্গ বা প্রাণী আক্রমণ করিলে কিছু প্রজাতির গাছ বাতাসে রাসায়নিক ভাসাইয়া দেয়। সেই ‘গন্ধ’ গ্রহণ করিয়া অপর গাছগুলিও ‘সতর্ক’ হইয়া যায়। তাহারা আপন পাতায় এমন রাসায়নিক লইয়া আসে, যাহার কটু-তিক্ত স্বাদ পরাহত করে পর্ণভোজীকে। পর্ণলোলুপ পতঙ্গের হানা রুখিতে পতঙ্গলোলুপ পক্ষীকে নিমন্ত্রণের গন্ধ-বার্তা পাঠায় উদ্ভিদ, এমন সাক্ষ্যও মিলিয়াছে। শুধু ফুলই নহে, কথা বলিতে পারে পাতাও।

অরণ্যে বৃক্ষদের বার্তা ও খাদ্য আদানপ্রদানের এক প্রধান মাধ্যম শিকড়, তাহাও দেখিয়াছেন বিজ্ঞানীরা। এক প্রকার ছত্রাকের সহায়তায় এই আদানপ্রদান চলিতে থাকে, এমনকি মৃত্যুতেও তাহার সমাপ্তি হয় না। যাহার শাখা-পত্র-ফুল কিছুই আর নেই, তেমন কাণ্ডকেও বহু দিন পুষ্টি জুগাইয়া বাঁচাইয়া রাখে শিকড়-জালিকার সম্মিলিত খাদ্যবণ্টনের ব্যবস্থা। আবার একটি পতিত বৃক্ষকাণ্ড বিলীন হইবার পূর্বে কয়েক দশক ধরিয়া অগণিত প্রাণীর জন্ম ও আশ্রয়ের স্থল হইয়া থাকে। কত প্রকার বার্তা, কত বিচিত্র রূপে গাছেরা পরস্পরকে পাঠাইয়া থাকে, এবং বৃক্ষজগতের সহিত কীটপতঙ্গ, পশুপক্ষীর কত বিচিত্র বার্তা-বিনিময় নিয়ত চলে, কত ভাবে তাহারা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, বিজ্ঞান তাহার আভাসমাত্র পাইতেছে। দূষণের লক্ষণ কিংবা খরার পূর্বাভাস সেই তথ্য-মহাসাগরের ক্ষুদ্র দুই-একটি তরঙ্গমাত্র। উদ্ভিদজগৎ যেন একই গ্রহে এক ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ড, তাহার নিকটে থাকিয়াও তাহার অসীম রহস্য মানুষের অধরা রহিয়াছে। অবশ্য বিজ্ঞান যাহা প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, তাহাও বিস্ময় না জাগাইয়া পারে না। কেবল আলো, হাওয়া, মাটি ও জল হইতে যাহারা আকাশচুম্বী শাখা, সুমিষ্ট ফল, অপরূপ ফুল নির্মাণ করিতে পারে, তাহারাই তো বিশ্বকর্মা। তাহারা নিশ্চল বা নীরব নহে, তাহাদের চলন-বলন ভিন্ন। হয়তো মানুষ কথা শিখিবার পূর্বেই তাহারা বুঝিয়াছিল মানুষের ভাষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Spinach email Massachusetts Institute of Technology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE