E-Paper

‘দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে’

কলকাতার বাংলা আর নোয়াখালি বা চট্টগ্রামের বাংলা যেমন এক নয়, ঠিক তেমনই বীরভূমের বাংলা আর কোচবিহারের বাংলাও বহুলাংশে আলাদা। একটিকে অন্যটির চেয়ে ‘অধিকতর বাংলা’ বলে দাবি করতে পারেন কেবল ভাষা-সাম্রাজ্যবাদীরা।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ০৫:০৯

কোনও এক কাণ্ডজ্ঞানহীন পুলিশকর্মীর মন্তব্য? বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলে উল্লেখ করাকে এই ভাবে দেখার প্রশ্নই ওঠে না— বিজেপি নেতারাই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। অমিত মালবীয় থেকে শমীক ভট্টাচার্য, প্রত্যেকেই ‘বাংলাদেশি ভাষা’ শব্দবন্ধটির সঙ্গে একমত। বাংলা ভাষা কী এবং কয় প্রকার, নাগপুরের গৈরিক বাহিনীর কাছে সেই পাঠ নেওয়ার প্রয়োজন বাঙালির নেই। কিন্তু প্রশ্নটি আদৌ ভাষার নয়— প্রশ্নটি রাজনীতির— ফলে, বিজেপি নেতাদের কথাগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। বাংলা ভাষাকে তাঁরা ভাঙতে চান হিন্দুর বাংলা এবং মুসলমানের বাংলা হিসাবে। এবং, হিন্দুরাষ্ট্রের সংজ্ঞা মেনে তাঁরা দ্বিতীয় গোত্রটিকে ভারতীয় ভাষার স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এই খেলা তাঁরা অনেক দিন ধরেই খেলে চলেছেন— জল বাংলা কিন্তু পানি নয়, বাবা বাংলা কিন্তু আব্বা নয়, ওয়টস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের গোড়াতেই এই ‘জ্ঞান’ রয়েছে। প্রথম কথা, বাংলা ভাষা বিজেপি নেতাদের স্বীকৃতির মুখাপেক্ষী নয়, সুতরাং তাঁরা অনধিকার চর্চা এখনই বন্ধ করুন। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় রাজনীতির মিশেলের কারবারিরা বাদেও যদি কারও মনে ভাষা বিষয়ে এই প্রশ্ন জাগে, তবে তিনি আগে অন্য এক প্রশ্নের উত্তর দিন যে, অঞ্চলবিশেষে যখন ভাষার রূপ পাল্টে যেতে থাকে, তখন কি তার কোনওটিকেই কি ‘একমাত্র’ রূপ হিসাবে গণ্য করা যায়? কলকাতার বাংলা আর নোয়াখালি বা চট্টগ্রামের বাংলা যেমন এক নয়, ঠিক তেমনই বীরভূমের বাংলা আর কোচবিহারের বাংলাও বহুলাংশে আলাদা। একটিকে অন্যটির চেয়ে ‘অধিকতর বাংলা’ বলে দাবি করতে পারেন কেবল ভাষা-সাম্রাজ্যবাদীরা।

এ সব বিতর্ক চলুক, তবে আসল কথা, বিজেপির রাজনীতি আদৌ বাংলার আঞ্চলিক প্রভেদ নিয়ে নয়, বরং স্পষ্টতই তা সামগ্রিক বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আক্রমণ। দিল্লির পুলিশকর্মীটি যে নথিকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’য় লেখা সাব্যস্ত করেছেন, সেটি ভারতের সরকারি নথি। তা প্রামাণ্য বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়, কোনও আঞ্চলিক বয়ানে নয়। এটাই বিজেপির রাজনীতির জয়। জনমগজে তারা এই কথাটি ভরে দিতে পেরেছে যে, (গরিব) বাঙালি মাত্রেই বাংলাদেশি, বাঙালি মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন যথার্থই বলেছেন যে, এটি সরাসরি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আক্রমণ। বাঙালির বিরুদ্ধে আক্রমণ। এবং, সেই আক্রমণের শিকড় নিহিত রয়েছে বিজেপির হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের দখলমূলক রাজনীতিতে। জাতিগত ভাবে বাঙালি এখনও বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে যথেষ্ট জমি ছাড়েনি, ফলে ভাষাগত আধিপত্য চাপিয়ে দিয়ে বাংলার মাটিকে দখল করার চেষ্টা। বঙ্গ বিজেপির নেতারা যে ভঙ্গিতে বাংলা ভাষার, বাঙালির এই অপমানকে ন্যায্য, যথাযথ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন— সেটাই স্পষ্ট বলে দেয়— এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, গৈরিক রাজনীতির মৌলিক কৌশলেরই অঙ্গ।

বাংলা ভাষার উপরে, বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে এই আক্রমণের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ সরবতা আশা জাগায়। এ বার কি তাঁরা বুঝছেন যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুই হোক বা ভাষাগত সংখ্যালঘু, হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের রাজনৈতিক প্রকল্প সবার বিরুদ্ধেই সমান ভাবে সক্রিয়? একশৈলিক ভারত গঠনের বিরুদ্ধে যেখানেই বাধা, এই রাজনীতি তাকেই গুঁড়িয়ে দিতে চায়। বাঙালি তথা ভারতীয় নাগরিক যদি আজ এই অতি সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বিপক্ষে গিয়ে বলতে না পারে যে, ধর্মীয় মৌলবাদ বা ভাষাগত মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই পৃথক নয়, তবে ভারত নামক উদারবাদী, গ্রহণশীল, সর্বজনীন ধারণাটি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে যিনি রক্ষা করেন, সেই জনগণদুঃখত্রায়ক ভারতমাতার রূপকল্পটিকে রক্ষা করতে, বৈচিত্রকে রক্ষা করতে ভারতীয়রা— বাঙালিরা— চেষ্টা করবেন কি না, এখনই তার পরীক্ষা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy