কলকাতার বেসরকারি বাসে চড়লে আগে ভিতরের দেওয়ালে কতকগুলি লেখা চোখে পড়ত: ‘মালের দায়িত্ব আরোহীর’ বা ‘১০০/৫০০-র খুচরা নাই’ যেমন, তেমনই: ‘আপনার ব্যবহারই আপনার পরিচয়’। সব যাত্রী সর্বদা যে এগুলি মানতেন তা নয়, তবে ভাববাচ্যে লেখা এই উপদেশনাগুলি অন্তত চোখের সামনে জ্বলজ্বল করত স্বল্পসময়ের যাত্রাপথে। ‘পাবলিক বিহেভিয়র’ বা লোকব্যবহার কেমন হবে তা বুঝতে বাঙালি ইস্কুল-কলেজের পাঠের অপেক্ষা করেনি, তার পারিবারিক ও সামাজিক সিলেবাসেই আছে লোকব্যবহারের বর্ণপরিচয়। অন্তত ছিল। বাঙালিদের সম্পর্কে ভারতীয় অন্য জাতিগোষ্ঠী ও বিদেশিদেরও এই বোধটি দীর্ঘলালিত যে, ভারতের পূর্ব দিকের, নদীবিধৌত, উর্বর এই ভূখণ্ডের ভূমিপুত্রকন্যারা নম্র, বিনয়ী ও উদার, হাস্যমুখ, পরহিতৈষী। বস্তুবৈভব নয়, শিক্ষাকে তারা আদর-কদর করে বেশি, এবং সেই শিক্ষার সূত্রেই সহবত, সৌজন্য, লোকব্যবহারের শিল্পটিও তাদের করায়ত্ত। এমন সসম্ভ্রম রসিকতাও চালু আছে, নানা জাতির মানুষে ভরা এক কল্পিত ভোজসভায় বাঙালিকে চেনা যাবে সহজেই, কারণ অন্যেরা যেখানে পাত পাড়তে ব্যস্ত, বাঙালি সেখানে সবার আগে নেবে পরিবেশনের ভার।
এই জাতিবৈশিষ্ট্য কি বাঙালি আজ ভুলতে বসেছে? তার কি বিনয় গেছে, স্পর্ধা এসেছে? রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, সভা-সমিতিতে, হাটে-বাজারে বাঙালির লোকব্যবহার আর আগের মতো নেই, সকলেরই যেন খুব তাড়া, সবাই খুব অধৈর্য ও অস্থির— এ-হেন মন্তব্য ও মূল্যায়ন এখন অনেকেরই। কেউ বলছেন সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধেরও একটা বড়সড় বদল ঘটে গেছে কোথাও, পাল্টে গেছে শ্রদ্ধা-সম্মান-সমীহের সংজ্ঞা। তথ্য-প্রযুক্তি, বিশেষত আন্তর্জাল ও তার সূত্রে সমাজমাধ্যমের বাড়বাড়ন্তকেই দায়ী করছেন অনেকে— সমাজমাধ্যমে পর্দার এ-পার থেকে ও-পারে যাকে যা খুশি বলা যাচ্ছে, এই যথেচ্ছাচারকে সমাজজীবনের আচরণেও হাতিয়ার করছে বয়স-লিঙ্গ-পেশা নির্বিশেষে সবাই। মেট্রোয় উঠে দেখা যাচ্ছে প্রবীণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের জন্য সংরক্ষিত আসনে জাঁকিয়ে বসে চলেছে তরুণদল, সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক বা অসুবিধা-পীড়িত মানুষটিকে দেখেও তাদের কোনও ভাবান্তর ঘটছে না। বয়সের দোষ বা ধর্ম বলে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, কারণ চলার পথে এও দেখা যাচ্ছে আশেপাশে কে আছে তার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে মোবাইলে তারস্বরে রিল চালাচ্ছেন বহু সহযাত্রী— তরুণ বা মধ্যবয়সি, নারী বা পুরুষে ভেদ নেই। গণপরিবহণে সামান্য আসন ভাগ করে নেওয়া নিয়ে বেধে যাচ্ছে বচসা, ব্যাঙ্ক-ডাকঘর থেকে শুরু করে দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার অপেক্ষমাণ লাইনেও যেন একটাই অভীষ্ট, কে অন্যকে টপকে আগে সফল হবে। সাফল্যের সংজ্ঞাও যাচ্ছে পাল্টে: ট্রাফিক সিগন্যাল ভেঙেও কে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পেরেছে, উৎসবের সময় রাতভর কারা বিনা প্রতিবাদে বাজি ফাটাল— তা-ই হয়ে উঠছে গর্ব করার মতো কাজ।
অনেকে বলবেন, এই আচরণের দায় কেবল বাঙালির ঘাড়ে চাপানো কেন, অনাচার-কদাচারে তো জাতি-ভেদ নেই। আধুনিক সমাজজীবনে এখন নানা ভাষা-ধর্ম-জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান, একের লোকব্যবহার অন্যকে শুধু প্রভাবিতই করছে না, এমন বার্তাও দিচ্ছে যে, বহির্মুখী উগ্র আচরণই এ যুগে কাজের, শ্রদ্ধা বিনয় ইত্যাদি দৌর্বল্য। প্রযুক্তির রমরমায় মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতাও আজ সামাজিক বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে, আর সবার উপরে আছে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলির প্রভাব— তাদের রূঢ়তা চারিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি-মানুষে। এই সব কিছু মিলেমিশে তার সামাজিক আচরণ হয়ে উঠছে অস্থির, রুক্ষ। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, উগ্রতা এক রকম ‘সারভাইভাল ড্রাইভ’ও, যে মানুষ ভিতরে ভিতরে নানা অনিশ্চয়তা ও অপ্রাপ্তিতে দীর্ণ, বাইরের রুক্ষতা দিয়ে সে তা ঢাকতে চায়। বিনা কারণেই রূঢ় আচরণকারী মানুষকে পাল্টা রূঢ়তা ফিরিয়ে না দিয়ে যদি জিজ্ঞেস করা যায় তার কী হয়েছে, তার মন ভাল আছে কি না— তা হলে দেখা যাবে মুহূর্তেই তার আচরণের বদল ঘটেছে, আগের উগ্রতা মুছে স্বাভাবিক মানুষটি ফুটে বেরোচ্ছে। আসল কথা এই দরদ ও সমানুভূতি— সামাজিক আচরণেরও এরাই চালিকাশক্তি। বিদ্যা শিল্প সংস্কৃতি চর্চার পাশে এই সমানুভূতির অনুশীলনও বাঙালির উত্তরাধিকার। আজকের সামাজিক কদাচরণের যুগেও তাকে তা মনে রাখতে হবে। বাসের গায়ে লেখা ওই সহজ সত্যের মতো, লোকব্যবহারই তার পরিচয়; স্পর্ধার মুখে প্রত্যয়ী বিনয়ই তার মানবিক উত্তর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)