E-Paper

শিরোনামের আড়ালে

জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭)-র যে সুপারিশ ছিল মোট বাজেটের অন্তত আড়াই শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা— তা এ বারেও হল না।

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫৭

ভারতে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে অসুখগুলি দীর্ঘ দিন বাসা বেঁধে রয়েছে, সেগুলিকে উৎপাটন বা প্রশমনের তেমন কোনও চেষ্টার দেখা মিলল না এ বার বাজেটে। চলতি অর্থবর্ষের তুলনায় বরাদ্দ দশ শতাংশের মতো বেড়ে আগামী অর্থবর্ষের বরাদ্দের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ছিয়ানব্বই হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তা মোট বাজেটের দু’শতাংশও নয়। অর্থাৎ, জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (২০১৭)-র যে সুপারিশ ছিল মোট বাজেটের অন্তত আড়াই শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা— তা এ বারেও হল না। উপরন্তু, কোভিডের জন্য বছর দুই বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানোর পর গত বছর দুয়েক ফের নিম্নমুখী হয়েছে টাকার অঙ্ক। এ বারও যে তা বরাদ্দ বাড়ল না, সেটা উদ্বেগজনক। স্বাস্থ্যের ভিতরে নানা খাতের মধ্যে বরাদ্দ বেড়েছে প্রধানত আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনায়। গত বারের চাইতে ৯৪০০ কোটি টাকা বেশি (২৯ শতাংশ বৃদ্ধি) বরাদ্দ হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের সব সত্তরোর্ধ্ব মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যবিমার কথা ঘোষণা করেছিলেন আগেই, বাজেট-বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গিগ কর্মীদেরও সেই সুবিধা দানের কথা ঘোষণা করেছেন। উদ্দেশ্য মহৎ, তবে স্বাস্থ্য বিমার প্রসার বাড়িয়ে সামাজিক ন্যায়ের উদ্দেশ্য কতটা সাধিত হচ্ছে, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গৃহস্থালির ভোগব্যয় বিষয়ে জাতীয় সমীক্ষা (২০২২-২৩) দেখিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে রয়ে গিয়েছে অধিকাংশ নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্ণ পরিবার। বিমাভুক্ত পরিবারগুলির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জনজাতি এবং দলিত। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির দশ শতাংশও হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ মেটাতে কেন্দ্রের বিমার সুবিধা পায়নি। এই পরিস্থিতিতে বিমায় বরাদ্দ বাড়ালে তা দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষদের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাবে কি?

দরিদ্রের চিকিৎসা-বঞ্চনার সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় তীব্র হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যের বরাদ্দের দিকে দেখলে। স্বাস্থ্য বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যে বরাদ্দ করার সুপারিশ করেছিল জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি। পরবর্তী সাত বছরে সেই বরাদ্দ চল্লিশ শতাংশের আশেপাশেই রয়ে গেল। জনস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করে উচ্চতম স্তরের হাসপাতালকে প্রাধান্য দেওয়ার ঝোঁক অব্যাহত। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছিলেন তামাক এবং শর্করা-প্রধান খাবারে জিএসটি বাড়াতে, স্বাস্থ্য সেস বসাতে। সরকার কান দেয়নি। চিকিৎসা সুলভ করতে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পণ্য ও পরিষেবার উপর জিএসটি বেঁধে দেওয়ার সুপারিশ ছিল। স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামের উপর জিএসটি আঠারো শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে কমানোর দাবি ছিল। জরায়ুর ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে টিকার (এইচপিভি) ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে মেয়েদের সুরক্ষিত করার প্রস্তাব ছিল। কোনওটিই পূর্ণ হয়নি।

নাকের বদলে নরুনের মতো মিলেছে ক্যানসারের কয়েকটি দামি ওষুধের উপরে শুল্ক ছাড়। সেই সঙ্গে দু’শোটি হাসপাতালে ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। ক্রমে ক্রমে সব জেলা হাসপাতালে এই সব কেন্দ্র খোলা হবে। এই উদ্যোগ সাধুবাদের যোগ্য, তবে গোড়ায় প্রয়োজন ক্যানসার শনাক্তকরণ এবং দ্রুত অস্ত্রোপচারের সুযোগ, সহজে যার নাগাল পেতে পারবেন সর্বস্তরের মানুষ। সে ব্যবস্থা না করে ক্যানসার রোগীদের জন্য দিবা পরিচর্যা কেন্দ্র তৈরি করা কতটুকু কাজ দেবে? ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে নতুন উদ্যোগ, কিংবা আরও দশ হাজার নতুন মেডিক্যাল আসন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত, এই সব ঘোষণা বাজেট-বক্তৃতার পরে সংবাদের শিরোনামে দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু স্বাস্থ্য-বরাদ্দে কার্পণ্য— মাত্র দশ শতাংশের মতো বৃদ্ধি— বুঝিয়ে দেয় যে চলতি পরিষেবা ও প্রকল্পগুলিই কোনও ক্রমে চালানোর বন্দোবস্ত হয়েছে কেবল। আরও আধুনিক, আরও সাম্যময় স্বাস্থ্যব্যবস্থা মিলবে কী করে, তার উত্তর পেতে ফের পরবর্তী বাজেটের জন্য অপেক্ষা শুরু হল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Health Medical

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy