Advertisement
E-Paper

বরাদ্দ ঔদাসীন্য

শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সূচকের বিচারে এই দেশ— চিন তো দূরস্থান— এমনকি সাহারার দক্ষিণবর্তী অনুন্নত আফ্রিকার অনেক দেশেরও পিছনে।

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৩৫
Share
Save

ভারতে আঠারো বছরের কম বয়সিদের সংখ্যা এখন ৪০ কোটির বেশি। এই মাপকাঠিতে চিন দ্বিতীয়, সংখ্যা ৩০ কোটির কম। আগামী দু’তিন দশকে এই ব্যবধান আরও বাড়বে। অর্থাৎ, গোটা বিশ্বে ভারতীয় শিশু-কিশোরের সংখ্যা কেবল সর্বাধিক নয়, নিকটতম প্রতিযোগীর থেকে এই দেশ অনেক এগিয়ে এবং ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। শিশু ও কিশোরদের ভাবী নাগরিক আখ্যা দেওয়া হয় এবং বিভিন্ন উপলক্ষে সেই আখ্যা নিয়ে বিস্তর বাগাড়ম্বর করা হয়। এমন একটি দেশ সব থেকে বেশি শিশুবহুল দেশ হলে বিশ্বের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দেশের শিশুবহুলতা ভবিষ্যতের পক্ষে গভীর উদ্বেগজনক। তার কারণ, অগণন ভারতীয় শিশু জীবনের ন্যূনতম সুযোগ, সক্ষমতা ও অধিকার থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। শিশুদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি সূচকের বিচারে এই দেশ— চিন তো দূরস্থান— এমনকি সাহারার দক্ষিণবর্তী অনুন্নত আফ্রিকার অনেক দেশেরও পিছনে।

এমন একটি দেশের সরকার সর্বশক্তি দিয়ে শিশুদের হাল ফেরাতে তৎপর হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। সেই তৎপরতার একটি মাপকাঠি অবশ্যই বাজেট-বরাদ্দ। সুতরাং, প্রশ্ন করা যাক, গত শনিবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে শিশুদের জন্য বরাদ্দ কত? একটি বাজেটে কোন কোন খাতের কত টাকা ‘শিশুদের জন্য’ বরাদ্দ বলে গণ্য করা হবে তার হিসাব কষার নানা পদ্ধতি আছে, সুতরাং অঙ্কটি নিয়ে সব সময়েই তর্ক থাকে। কিন্তু বছরে বছরে সেই অঙ্ক কতটা বাড়ছে, সেটি শিশুদের প্রতি সরকারি দায়বোধের সূচক হিসাবে অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবান। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৫.৬৫ শতাংশ। কিন্তু এই পরিমাপ যথার্থ ছবিটি দেখায় না। প্রথমত, এই বৃদ্ধি টাকার অঙ্কে, অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধির মাত্রা ধরে নেওয়ার পরে প্রকৃত বৃদ্ধি যৎসামান্য। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের যে কোনও বরাদ্দের মতোই এ ক্ষেত্রেও সরকারি ব্যয়ের অঙ্কটিকে জাতীয় আয় তথা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাত হিসাবে দেখা বিধেয়। এবং সেই অনুপাতটি কষলেই উন্মোচিত হয় এক লজ্জাকর চিত্র: গত অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) ‘শিশু বাজেট’ ছিল জিডিপির ০.৩৪ শতাংশ, এ বছর সেই অনুপাত দাঁড়াতে চলেছে ০.৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ, দুনিয়ার সর্বাধিক অপুষ্ট এবং শিক্ষাহীন স্বাস্থ্যহীন সম্ভাবনাহীন শিশুর দেশে যে কাজে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া অত্যাবশ্যক, সেখানে শিশুদের জন্য বাজেটের বরাদ্দ আনুপাতিক বিচারে বাড়ছে না, কমছে!

না, এই অধঃপাত নতুন নয়, এক দশকের বেশি সময় ধরে শিশুদের জন্য সরকারি ব্যয়বরাদ্দের অনুপাত কমেই চলেছে। একটি হিসাব অনুসারে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে ২০১২-১৩ সালে বরাদ্দ ছিল মোট সরকারি ব্যয়ের ৪.৭৬ শতাংশ, এখন তা দাঁড়িয়েছে ২.২৯ শতাংশ। আবারও, নির্দিষ্ট অনুপাতটি নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, তার অধোগতি নিয়ে তর্ক নেই। এই বিষয়ে দেশের বহু রাজ্যের সরকারও একই অপরাধে অপরাধী। পশ্চিমবঙ্গকেও তার ব্যতিক্রম বলে মনে করার কোনও উপায় নেই। বিশেষত শিশুদের শিক্ষার প্রতি যে এ-রাজ্যের শাসকদের ঔদাসীন্য অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে, তার প্রমাণ এখন শিশুশিক্ষার সমগ্র সরকারি ব্যবস্থাটি জুড়ে প্রকট। গভীরতম সমস্যা এখানেই যে, এই ঔদাসীন্য নিয়ে নাগরিক সমাজেরও কোনও সচেতনতার চিহ্ন নেই। এই বাস্তবটির মধ্যে এক বৈষম্যতাড়িত সমাজের অন্তর্নিহিত মানসিকতার পরিচয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। সত্য এই যে, যাঁদের আর্থিক ও সামাজিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা বাজার থেকে এবং নিজস্ব যোগাযোগের ভিত্তিতে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন, যাঁদের সরকারি ব্যবস্থাই ভরসা, তাঁদের জন্য সরকারি ঔদাসীন্যই বরাদ্দ ছিল, আছে এবং থাকবে। কেন্দ্রীয় বাজেটে সেই সত্যই প্রতিফলিত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Children teenagers Rights

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}