এ বার কোপ গ্রাম উন্নয়নের টাকার উপর। চলতি অর্থবর্ষে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন থেকে পঞ্চায়েতের উন্নয়নের জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য ছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। সেই অনুদান আটকে দিয়েছে কেন্দ্রের পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রক। কেন্দ্রের অভিযোগগুলি পরিচিত— নির্দিষ্ট নিয়মবিধি মানেনি রাজ্য সরকার। ষষ্ঠ রাজ্য অর্থ কমিশন তৈরির (২০২৪) ক্ষেত্রে সদস্যদের যোগ্যতার মাপকাঠি লঙ্ঘন করা হয়েছে। পঞ্চম রাজ্য অর্থ কমিশনের রিপোর্ট এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে, তার রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করার মতো শর্তও মানেনি। এমন নানা অনিয়ম দর্শিয়েই একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, জল জীবন মিশনের মতো প্রকল্পের টাকা আটকে দিয়েছে কেন্দ্র। দুর্নীতির তদন্ত অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে অপর একটি প্রশ্ন— এ ভাবে প্রাপ্য টাকা আটকানোর অধিকার কি কেন্দ্রের রয়েছে? অনুদানের গতি স্তব্ধ করলে মানব উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়। আপত্তিটি আরও তীব্র হয় অর্থ কমিশনের টাকা আটকালে, কারণ এ কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অনুদান নয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সংবিধানের ৭৩ এবং ৭৪তম সংশোধনীতে সংবিধানের ২৮০(৩) ধারানুসারে কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের কাজ প্রতিটি রাজ্যের পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির উন্নয়নের জন্য বাড়তি অনুদান দেওয়া। রাজ্য অর্থ কমিশনগুলির সুপারিশ বিবেচনা করে কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশন অনুদানের অঙ্ক স্থির করবে। পঞ্চদশ অর্থ কমিশন ২০২১-২৬’এ সারা দেশে স্থানীয় সরকারগুলির জন্য ২ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি টাকা অনুদানের সুপারিশ করেই রেখেছে। সেই অনুসারে প্রতি বছর টাকা পাঠাচ্ছে কেন্দ্র। সংবিধান-নির্দিষ্ট এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার স্বাধীনতা কেন্দ্রের পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রকের রয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
একই প্রশ্ন আদালতে উঠেছিল মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের টাকা নিয়েও। হিসাবে গরমিল এবং দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্র টাকা আটকে দিতে পারে, এমন কথা আইনে নেই, বলেছিল আদালত। স্বচ্ছতার জন্য যে কোনও শর্ত দিতে পারে কেন্দ্র, কিন্তু জনস্বার্থে প্রকল্প চালু রাখতে হবে, রায় দিয়েছিল আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্র গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু হাই কোর্টের মূল যুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থার ভারসাম্য এবং নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা, দু’টিকেই সমর্থন করে। একই যুক্তি প্রযোজ্য কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের বরাদ্দের ক্ষেত্রেও। রাজ্য অর্থ কমিশনের রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করা, তার সুপারিশ অনুসারে রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করেছে তার বিবরণ প্রকাশ করা, পঞ্চায়েতকে যথাসময়ে টাকা পাঠানো, এ সব বিধিপালনে রাজ্যের ত্রুটি ঘটে থাকলে তা নিন্দনীয়। অর্থ কমিশন নির্মাণে অনিয়ম হয়ে থাকলে তা-ও দুর্ভাগ্যজনক। সত্যটি কী, তার নাগাল পাওয়ার আশা সামান্যই। দলীয় রাজনীতি সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানকে এমনই গুলিয়ে দেয় যে, নাগরিক নানা সন্দেহের আবর্তে ঘুরতে থাকে।
কিন্তু অপচয় বন্ধ করার অছিলায় উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করার রাজনীতি যে নাগরিকের প্রতি সরকারের চূড়ান্ত অন্যায়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কেন্দ্রের অর্থ কমিশনের টাকার একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে পঞ্চায়েত ও পুরসভাগুলির কাছে। তা হল, এই বরাদ্দের একটি অংশ শর্তহীন (‘আনটায়েড’)। রাজ্য বা কেন্দ্রের নির্দিষ্ট প্রকল্পে ৬০ শতাংশ টাকা খরচ করে স্থানীয় সরকারগুলি, বাকিটা এলাকার প্রয়োজন অনুসারে নানা খাতে খরচ করতে পারে। সংবিধান সংশোধন করে স্থানীয় সরকারের স্বাতন্ত্র্য ও সক্ষমতার যে আদর্শ এক দিন ভারত নির্মাণ করেছিল, দলীয় রাজনীতি বহু আগেই তাকে নস্যাৎ করেছে। পড়ে রয়েছে শর্তহীন এই তহবিলটুকু। কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের টাকা আটকে দিলে স্থানীয় সরকারের শেষ মর্যাদাটুকু কেড়ে নেওয়া হয়। এ যেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে সরকারি স্বাক্ষর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)