E-Paper

অস্মিতার সীমা

মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, এই প্রথম বার বাঙালি ভিন রাজ্যে বিদ্বেষের সম্মুখীন হচ্ছে— আর্থ-সামাজিক শক্তির জায়গা থেকে নয়— বরং, প্রশ্নাতীত রকম দুর্বল এক অবস্থান থেকে।

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৩

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি অস্মিতাই যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানতম রাজনৈতিক অস্ত্র হতে চলেছে, তা তিনি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী হিসাবে বাঙালি পরিচিতির সংহতির রাজনীতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে। পরিচিতিকেন্দ্রিক দুই রাজনীতির মধ্যে ফারাকটি অবশ্য প্রশ্নাতীত— একটি রাজনীতি বর্জনের, অন্যটি গ্রহণের; একটি রাজনীতি অপরায়ণের, অন্যটি সর্বজনীনতার। এমন আশঙ্কা অমূলক নয় যে, শেষ অবধি বাঙালি অস্মিতার পুরোটাই ঘেঁটে গিয়ে হাতে থাকবে কিছু পুরনো তরজা; কিন্তু অন্তত এই মুহূর্তে অস্ত্রটিতে তৃণমূলের উভয় গোত্রের প্রতিদ্বন্দ্বীই চমকিত। মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য তার প্রমাণ। কিন্তু, বাঙালি অস্মিতার এই রাজনীতিতে একটি মোক্ষম খামতি থেকে গিয়েছে। তার নাম অর্থনীতি। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, এই প্রথম বার বাঙালি ভিন রাজ্যে বিদ্বেষের সম্মুখীন হচ্ছে— আর্থ-সামাজিক শক্তির জায়গা থেকে নয়— বরং, প্রশ্নাতীত রকম দুর্বল এক অবস্থান থেকে। বিভিন্ন রাজ্যে যে বাঙালি নানাবিধ হিংসার সম্মুখীন হচ্ছে, সে বাঙালি সেই রাজ্যগুলিতে উপস্থিত সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতম অংশের প্রতিনিধি হিসাবে— তারা এক দিকে দরিদ্র, অন্য দিকে স্বভূমি থেকে (স্বেচ্ছা)বিচ্যুত। এই বাঙালির পাশে দাঁড়াতে গেলে রাজ্যের নিজস্ব জোর থাকা প্রয়োজন। অতীত গৌরবের জোর নয়, এমনকি দেশের শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রবলতম বিরোধী নেত্রীর রাজ্য হিসাবে পরিচিতির জোরও নয়— অর্থনৈতিক জোর প্রয়োজন।

দরিদ্র অভিবাসীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ক্ষোভ এক বৈশ্বিক সত্য। রাজনীতি সেই ক্ষোভকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যেমন তার মুসলমান-বিরোধিতার তিরকে ঘুরিয়ে দিয়েছে দরিদ্র বাঙালি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। ঘটনা হল, অদক্ষ, অর্ধদক্ষ, এমনকি দক্ষ কায়িক শ্রমিকের বিরুদ্ধেও এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ তুলনায় সহজ— বিশেষত, সেই শ্রমিকরা যদি আর্থিক ভাবে দুর্বলতর রাজ্য থেকে আসেন। তার একটি কারণ হল, ভিন রাজ্যে মার খেয়েও পড়ে থাকাই অনেকের কাছে তুলনায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিকল্প— কারণ, ফিরে এলে এ রাজ্যে কাজের সংস্থান হবে না। যাঁদের প্রত্যাঘাত করার জোর নেই, এমনকি মার খেয়ে পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই, তাঁদের মারা বড় সহজ কাজ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমজীবী বাঙালি আজ তেমন অবস্থানে আছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি তাঁদের হয়তো খানিক সাহস দেবে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনও বিকল্পের ব্যবস্থা করবে না। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, এ রাজ্যে যথেষ্ট কাজ আছে। সত্যই কি আছে যথেষ্ট অর্থপূর্ণ কাজ? একশো দিনের প্রকল্পে মাটিকাটার কাজ নয়, এমন কাজ যা ভিন রাজ্যের কাজের সমান না হোক, অন্তত কাছাকাছি বেতন দিতে পারে? রাজ্যবাসী এই প্রশ্নের যে উত্তর জানেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ফেরার আহ্বানে সাড়া দিতে সাহস পাওয়া মুশকিল। বাঙালি অস্মিতার রাজনীতিকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে অতএব অর্থনীতির দিকে মন দেওয়া প্রয়োজন। বৃহৎ শিল্পের আবাহন যদি না-ও হয়, ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পের বিকাশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। মুখ্যমন্ত্রী খেয়াল করে দেখতে পারেন, ভারতের যে রাজ্যগুলিতে গত তিন-চার দশকে প্রাদেশিক অস্মিতার রাজনীতি সফল হয়েছে, তার প্রতিটিই আর্থিক ভাবে সফল। গুজরাত বা মহারাষ্ট্রে কেন অস্মিতার রাজনীতি বলীয়ান, আর বিহার বা মধ্যপ্রদেশে কেন নয়, সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলেই বাঙালি অস্মিতার রাজনীতির সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy