E-Paper

দায়বোধ কোথায়

গত সেপ্টেম্বরেই সুপ্রিম কোর্ট একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় হিমাচল প্রদেশকে নির্দেশ দিয়েছে অক্টোবরের শেষের মধ্যে পরিবেশ পরিবর্তনের বিষয়টি বুঝে নিয়ে তার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জানাতে।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩২

বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে, এত দিনে তা স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সকলেই বুঝছেন সেই ইংরেজি প্রবাদটির মর্ম: (এখন, এই অঞ্চলে) ‘যা কিছু খারাপ হতে পারে, সবই হবে’। চলমান বছরে জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বর্ষায় যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল, তা অভূতপূর্ব। বর্ষা ঋতু আবহমান কাল ধরেই আসে-যায় এই উপমহাদেশে, হিমালয় পর্বতরাজিও ভারতের উত্তর সীমানাময় প্রহরারত আজ বহু সহস্র বছর। কিন্তু এতখানি ক্ষতি এত স্বল্প সময়ে— অতীব উদ্বেগজনক। এ বছর মেঘভাঙা বৃষ্টির কবলে পড়েছে মান্ডি, কুলু, মানালি, চম্বা, দেহরাদূন এবং উত্তরবঙ্গ। যেখানে পর্যটকরা সচরাচর ভিড় জমান সম্বৎসর, ছুটির সময়েও সেগুলি এ বার ভিড়বিহীন— দুই দিক থেকেই সঙ্কটে স্থানীয় মানুষ। এক দিকে প্রকৃতির রোষ, অন্য দিকে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি। হিমাচল প্রদেশ একাই ৭০০ কোটির উপরে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। যে হেতু এত জলপ্লাবনে মাটির প্রবল ক্ষয় হয়, নতুন মাটি জমে যায় অস্থানে, কৃষির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও হিসাবের মধ্যে ধরে রাখতে হবে। ফলে বর্তমান পর্যটন এবং ভবিষ্যতের কৃষি ও কৃষিভিত্তিক বাণিজ্য— সব মিলিয়ে আর্থিক আঘাতটি বেশ জোরেই পড়তে চলেছে হিমাচলবাসীদের উপর। এই বছরের কথা যদিও আলাদা করে বলা হচ্ছে, তবে গত এক দশক ধরেই পরিবর্তনের ধারাটি লক্ষণীয়। একই সমস্যায় নেপাল ও ভুটানও, যদিও ভারতের দিকে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি। প্রকৃতির সঙ্গে নতুন বোঝাপড়ার চেষ্টায় হিমালয়ের এই দিকটির ব্যর্থতা অনেক বেশি, তাই বিপর্যয়ও বেশি।

গত সেপ্টেম্বরেই সুপ্রিম কোর্ট একটি স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় হিমাচল প্রদেশকে নির্দেশ দিয়েছে অক্টোবরের শেষের মধ্যে পরিবেশ পরিবর্তনের বিষয়টি বুঝে নিয়ে তার স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জানাতে। সর্বোচ্চ আদালত জোর দিয়েছে একটি মৌলিক সত্যের উপর: এই বিপর্যয় কেবল প্রকৃতির কারণে নয়, মানুষের কারণেও। হয়তো বা মানুষের কারণেই। সুতরাং এখনই পাল্টানো দরকার মানুষ-প্রকৃতি সম্পর্ক। বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস এই পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে। কেবল জনসংখ্যার বিষয়ই তো নয়, এই পর্বতাঞ্চল বহু কাল ধরে জন্ম দিয়েছে এবং লালন করেছে বহু সংস্কৃতি, যা বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। জটিল ভূপ্রকৃতি বা অত্যন্ত উচ্চতার জন্য হিমালয় পর্বত বিশ্বের অন্যান্য ভঙ্গিল পর্বতের থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। পার্বত্য ঝর্না থেকে জাত নদীগুলি এই উচ্চতার বিশেষত্বের কারণেই পাহাড়ের গা দিয়ে দ্রুতগতিতে সমতলে নেমে আসে। তা যেমন এক দিকে সৌন্দর্যের সমারোহ তৈরি করে, অন্য দিকে ঝুঁকিও বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। রাস্তা নির্মাণ খুব সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়ায়, খাদ্য-পানীয় থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার হরেক উপকরণ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী চলাচলের উপায় থাকে সীমিত। এই সব কারণে বন্যায় বা ধসে স্থানীয় পাহাড়ি জনবসতি বিপন্ন হয়ে পড়লে তাকে আবার নতুন করে জীবিকা নির্বাহের সংস্থান ও নিরাপত্তার অনুভূতি ফিরিয়ে দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়।

অথচ, সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প তৈরির সময় এই সব কথা মাথায় রাখা হয় না। এলোমেলো ভাবে চলতে থাকে অন্যায় রকমের বৃহৎ নির্মাণ যজ্ঞ। পরিবেশ-পরিবর্তন ও দুর্যোগের অবশ্যম্ভাবিতা মনে রেখে স্থানীয় ভিত্তিতে বিপদ মোকাবিলা এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি এখনও যৌথ সহযোগিতায় ভাবে না। উন্নয়নের নামে বেহিসাবি নির্মাণ বা পর্যটনের নামে প্রকৃতি ধ্বংস আগেও অপরাধ ছিল। এখনকার পরিস্থিতিতে তা অমার্জনীয় অপরাধ। সরকারের হুঁশ ফেরাতে চাই নাগরিক সমাজের সচেতনতা। তবে পাহাড়ের সঙ্গে আনন্দভ্রমণের সম্পর্কের বাইরে আর কিছু দায় নাগরিক সমাজের আছে কি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Himalayas Natural Disaster

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy