রবীন্দ্রনাথের শহরে কবিদের কি ঘোর দুর্দিন এল? রবীন্দ্রসদনের সদ্য-সমাপ্ত কবিতা উৎসবের মাঝেই বীরভূমের বগটুই গ্রামে নারকীয় কাণ্ডের সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে চার দিক থেকে কবিদের কাছে দাবি: আপনার প্রতিক্রিয়া? এ-কালের ধর্মই হল, রাজনীতিবিদ-কবি-চিত্রতারকা নির্বিশেষে মন্তব্য চাওয়া। এই মন্তব্য-বুভুক্ষু বঙ্গে কবিরাও এখন তরজার কুশীলব। প্রশ্নটা আসলে গভীর। কবিরা অনেকে বলবেন, তাঁদের জগৎটা অন্য রকম— একান্ত অনুভূতির। তাঁদের কাব্যবিশ্বের সঙ্গে চরাচরবিশ্বের একান্ত যোগ থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। তাঁদের সেই অনুভূতি সমাজ, রাজনীতি নিয়ে হতেও পারে, না-ও পারে। তাঁরা ক্ষমতার পক্ষে হতেও পারেন, বা নিষ্ফল-হতাশের দলেও হতে পারেন। এই যেমন, প্যারাডাইস লস্ট-এর মহাকবি মিল্টন জয়ী-পক্ষে ছিলেন, মধ্যযুগের ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমওয়েলের বিপ্লবের শরিক ছিলেন। ডিভাইন কমেডি-র স্রষ্টা দান্তে আবার ছিলেন ইটালিতে রাজনৈতিক ভাবে পরাজিতদের দলে, আমৃত্যু নির্বাসন ভোগ করেছেন। কবিতার জগৎ এ সব দলাদলি মনে রাখে না, সে জয়ী মিল্টন ও পরাজিত দান্তে দু’জনকেই মহাকবির আসনে বসিয়েছে। কিন্তু যে যুগের যে নিয়ম! তখন সংবাদমাধ্যম ছিল না, টিভি ক্যামেরা বাইট চাইত না। এখন অন্য যুগ, অন্য রাজনীতি। সেই রাজনীতির আগুনে গ্রাম পুড়লে কবির কমলাসন আর অক্ষত থাকে না। এখন তাই কবিদের জগৎ বাধ্যতামূলক ভাবে রাজনীতি-জগৎ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, ছাড়ান নেই।
কবির ভূমিকা কী ভাবে পাল্টেছে, এই শহর তার সাক্ষী। কলকাতায় আধুনিক কবিতার প্রথম উল্লেখ্য উৎসব প্রায় ৬৮ বছর আগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে ১৯৫৪ সালের ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি। উৎসবের আহ্বায়ক ছিলেন সিগনেট প্রেসের ডিকে বা দিলীপকুমার গুপ্ত, ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় ও সাহিত্যতত্ত্বের পণ্ডিত আবু সয়ীদ আইয়ুব। কবিতা অকাদেমি ইত্যাদি ছিল না, সরকারি আমলা ও কর্তাব্যক্তিরা তখনও ছড়ি ঘোরানোর অধিকার পাননি। কৃত্তিবাস পত্রিকায় সেই উৎসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, “জীবনানন্দ দাশ... যাঁর আবৃত্তি নিজের কবিতার প্রতি সুবিচার করবে কিনা এ বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট ভয় ছিল, তিনি এই সম্মেলনে তাঁর প্রথম তিনটি কবিতা আশ্চর্য সুন্দর পড়েছিলেন।” বাংলা ভাষার ‘নির্জনতম কবি’ও উৎসবে তবে ভেঙে দিয়েছিলেন তাঁর প্রথাসিদ্ধ ইমেজ! সেই বছরের শেষে ডিসেম্বরে ফের কবিতা উৎসব। এ বার ক্রিকেটের নন্দনকাননে। শঙ্খ ঘোষ সেখান থেকে প্রায় পালাতে চান, সুভাষ মুখোপাধ্যায় চেপে ধরে থাকেন তাঁর হাত। দুষ্টুমিও ছিল। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে সভাপতি কাজী আবদুল ওদুদ সে বার পূর্ণেন্দু পত্রীকে ছোট কবিতা পড়তে বলেছিলেন। পূর্ণেন্দুর কাছে একটি ছোট কবিতা ছিল, কিন্তু সভাপতির অনুরোধ শুনে তিনি পাঠ করতে লাগলেন তাঁর খসড়া খাতায় লেখা দীর্ঘতম কবিতাটি।
তার পরে ক্রমে এল শান্তিকল্যাণ। কবিতা উৎসব ক্রমে পোষ মানল। আজ কবিতা উৎসব যদি কবিতার সঙ্গে আদিখ্যেতারও উৎসব হয়ে থাকে, অবাক হওয়া যাবে না। লন্ডনে শেলি বা কিটসের নামে স্টেশন নেই, এখানে কবি নজরুল থেকে কবি সুভাষ আছেন স্টেশনের নামে। কবিরাও অনেকে খুশিমনে রাজনীতির বাইটপ্রবণ ক্রীড়নক হয়েছেন। গণহত্যা কবিতায় প্রভাব ফেলবে কি না, বা কবিকে আলপিন থেকে হাতি সব নিয়ে জুতসই কোট কেন দিতে হবে, সে প্রশ্ন শুনে আজ যাঁরা রাগ করছেন, তাঁদেরও মানতে হবে যে কবিরা এ জন্য কম দায়ী নন। এই বাংলাতে কিছু দিন আগেও এক গোত্রের কবি ছিলেন যাঁরা মিছিলে হেঁটেও নিরপেক্ষ নৈতিক দূরত্ববোধ থেকে ক্ষমতার রাজনীতিকে তফাতে রাখতে জানতেন। আর আজকের কবি-মিছিল সমানেই ক্ষমতার কাছে পৌঁছতে চায় সন্দেহ করলে ভুল হবে না। চিলির কবি নিকানার পাররা কবিসভায় কবিতা পাঠ করে বলতেন, “এত ক্ষণ যা বললাম, সবই নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলাম।” কারণ, কোনও শব্দেই জনতার অধিকার নেই, প্রতিটিতে লেগে আছে কবির নিজস্ব দায় ও মমত্ববোধের অঙ্গীকার। কবি-লেখক-শিল্পী প্রমুখ পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালদের সামাজিক দায় বোঝাতে গিয়ে এডওয়ার্ড সাইদ লিখেছিলেন, “বুদ্ধিজীবীর পাবলিক রোল এক জন আগন্তুকের— যে আগন্তুক বিঘ্ন সৃষ্টি করে।” এই যুগে কবিতা থেকে মিছিলে আছেন কি বিঘ্নসৃষ্টিকারী সেই আগন্তুক? না কি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপই আজকের সম্বল, “কবিরা কোথায় আজ?”
যৎকিঞ্চিৎ
মাস্ক নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে পরিমাণ হল্লা হয়েছে, তা নাকি হার মানিয়েছে পঁচাত্তর বছর আগে বিকিনির অভ্যুত্থানের পরবর্তী বিতর্ককেও— অঙ্ক কষে জানিয়েছেন দুই অধ্যাপক। বিতর্কের প্রাবল্যে মাস্ক কি তা হলে হারিয়ে দেয় হিজাবকেও? তবে সব হিসাবের উপরে, একটি কথা মানতেই হবে। এই প্রথম একটি বস্ত্রখণ্ড চাপিয়ে দেওয়া হল পুরুষদের উপর। বিতর্ক তো হবেই— এত দিন অবধি যে কে কী পরবে বা পরবে না, সেটা বলার অধিকারী ছিল কেবল পুরুষরাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy