Advertisement
১০ মে ২০২৪
UAPA

অবিচার

অভিযুক্তদের যে শেষ অবধি দোষী প্রমাণ করা যাইবে না, এই কথা সরকারপক্ষও জানে।

‘পিঞ্জরা তোড়’-এর দুই সদস্য দেবাঙ্গনা, নাতাশা এবং জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র আসিফ ইকবাল তানহা।

‘পিঞ্জরা তোড়’-এর দুই সদস্য দেবাঙ্গনা, নাতাশা এবং জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র আসিফ ইকবাল তানহা। ছবি সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২১ ০৬:০৬
Share: Save:

হতভাগ্য সেই দেশ, যেখানে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকারকে বারে বারেই স্মরণ করাইয়া দিতে হয় যে, শাসককে প্রশ্ন করিবার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহ নহে; প্রতিবাদ মাত্রেই তাহা আইনের গুরুতর উল্লঙ্ঘন নহে। হতভাগ্য সেই দেশ, যেখানে শাসকরা সজ্ঞানে গুলাইয়া দিতে চাহে দেশ এবং শাসকের মধ্যবর্তী ব্যবধান; শাসককেই রাষ্ট্রের অভিন্ন সত্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা চালাইয়া যায়। হতভাগ্য সেই দেশ, যেখানে শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করিবার ‘অপরাধ’-এ সাংবাদিককে বিনা বিচারে ছয় মাসেরও অধিক সময় জেলে পচিতে হয়। সেই হতভাগ্য দেশটির নাম ভারত, যেখানে অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করিয়া জেলবন্দি করা হয়; এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর করিতে গিয়া জেলে নিক্ষিপ্ত হন সাংবাদিক— রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। নাগপুরের শিক্ষাধন্য শাসকরা বিশ্বাসই করিতে পারেন না যে, গণতান্ত্রিক পরিসরে কোনও মতেই বিরোধীদের গুরুত্ব খর্ব করা চলে না। রাজনৈতিক বিরোধীরা, এবং নাগরিক সমাজের অন্যান্যরা যে প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেন, তাহাতে দেশের ক্ষতি নাই, বরং লাভ। শাসককে প্রতিনিয়ত সংযত থাকিতে, ন্যায়ানুগ থাকিতে বাধ্য করে গণতান্ত্রিক পরিসরে সদা জাগরূক বিরোধী অস্তিত্বগুলি। বিরুদ্ধ মতের সহিত সহাবস্থান, আলোচনার মাধ্যমে শাসন ইত্যাদির সহিত নাগপুরে পরিচয় হয় না। ফলে, তাঁহারা সর্বশক্তিতে এই প্রশ্নগুলিকে দমন করিতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন। হতভাগ্য সেই দেশ, যেখানে এমন একটি অগণতান্ত্রিক শক্তিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়।

সৌভাগ্য যে, দেশের বিচারবিভাগ এই প্রবণতাকে প্রতিহত করিতেছে। কিছু দিন পূর্বে শীর্ষ আদালত দুইটি পৃথক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল যে, দেশদ্রোহ আইনের গণ্ডিকে নূতন করিয়া সংজ্ঞায়িত করিবার সময় আসিয়াছে। প্রত্যেক সাংবাদিকেরই রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু হইতে নিরাপত্তার অধিকার আছে। কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে জামিন দিয়া নিম্নতর আদালত যেন শীর্ষ আদালতের সেই বক্তব্যেরই অনুসারী হইল। হাথরস-কাণ্ডের খবর করিতে আসা কাপ্পান-সহ অন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলায় এখনও প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারে নাই পুলিশ। ২০১২ সালে মহারাষ্ট্রের নান্দেড় হইতে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার হওয়া দুই যুবককেও মুক্তি দিল বম্বে হাই কোর্ট। সেখানেও একই কারণ— জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা নয় বৎসরেও প্রমাণ জোগাড় করিতে পারে নাই। নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়া গ্রেফতার হওয়া তিন বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়াকে জামিন দিয়া দিল্লি হাই কোর্ট জানাইল যে, প্রতিবাদী মাত্রেই জঙ্গি নহে। রাষ্ট্রের চোখে যদি এই ফারাক ঝাপসা হইয়া আসে, তবে তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে দুঃসংবাদ।

আদালতের অবস্থানে স্পষ্ট, কেন্দ্রীয় এবং মূলত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির সরকার যে ভঙ্গিতে ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইন ব্যবহার করিয়া প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করিতে চাহিতেছে, তাহা বেআইনি। সন্দেহ হয়, অভিযুক্তদের যে শেষ অবধি দোষী প্রমাণ করা যাইবে না, এই কথা সরকারপক্ষও জানে। তবুও এই ধারাগুলিতেই মামলা দায়ের করা হয়, যাহাতে বিরোধীদের বিনা বিচারেও বেশ কিছু দিন আটকাইয়া রাখা যায়। তদন্তকারী সংস্থা প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ হওয়া অবধি নিরপরাধ নাগরিককে কারাবন্দি হইয়া থাকিতে হইবে, এই অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। এই আইনগুলির সীমা নির্ধারণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ শীর্ষ আদালত ইতিমধ্যেই উত্থাপন করিয়াছে। সেই দাবিটিকে প্রবলতর করিয়া তুলিবার দায়িত্ব বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের উপরও বর্তায়। গণতন্ত্রে শাসককে সংযত থাকিতে বাধ্য করিবার কর্তব্য সম্পাদনে ত্রুটি হইলে চলিবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

UAPA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE