E-Paper

পরীক্ষা কঠিন

বীরভূমের মহম্মদবাজারে প্রস্তাবিত ডেউচা-পাঁচামি কয়লা খনির কাজ শুরু হতে চলেছে— বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা স্বাভাবিক ভাবেই সাড়া ফেলেছে।

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৩৮

কয়েকশো মিটার ব্যাসল্ট পাথরের নীচে আছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কয়লা-ভান্ডার। বীরভূমের মহম্মদবাজারে প্রস্তাবিত ডেউচা-পাঁচামি কয়লা খনির কাজ শুরু হতে চলেছে— বিশ্ব বাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা স্বাভাবিক ভাবেই সাড়া ফেলেছে। আনুমানিক ৩৫০০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করে রাজ্য অর্থনীতিকে যে নতুন স্তরে পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তার গুরুত্ব নিছক বিনিয়োগের অঙ্কে ধরা যাবে না। প্রত্যাশিত ভাবেই, দেশি শিল্পনায়কদের পাশাপাশি পোল্যান্ড এবং কানাডার মতো দেশ থেকেও এই প্রকল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রাথমিক আগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহ থেকে প্রস্তাব, প্রস্তাব থেকে বিনিয়োগ— অনেক পথ বাকি। কিন্তু যথাযথ ভাবে সেই পথ রচিত হলে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যের অর্থনীতিতে এক নতুন পর্বের সূচনা হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরের দিন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরুর সংবাদে সেই পর্বান্তরের সঙ্কেত মিলেছে।

‘যথাযথ ভাবে’ প্রকল্প রূপায়ণের কাজটি সহজ নয়। ভূপ্রকৃতির নিজস্ব সমস্যা তার একটি দিক। ব্যাসল্ট পাথরের স্তরটি বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন গভীরতায় প্রসারিত, ফলে কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তি এবং খরচ দুইয়েরই বিভিন্ন মাত্রা আছে, সেই অনুসারে পরিকল্পনা করা দরকার। কিন্তু সমস্যার এই দিকটি যত গুরুতরই হোক, তার থেকে অনেক বেশি জটিল হল প্রকল্পের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত। কয়লাখনি নির্মাণের ফলে স্থানীয় জনজীবনে যে পরিবর্তন ঘটবে, বিশেষত বসতি ও তার সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের উপর যে প্রতিক্রিয়া ঘটবে, তার সুষ্ঠু মোকাবিলা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়নের স্বার্থে সেই পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়াকে মেনে নিতে হবে, নান্যপন্থাঃ। এ ক্ষেত্রে সে-কথা দ্বিগুণ সত্য। তার কারণ, অন্য ধরনের প্রকল্পের স্থান পরিবর্তনের সুযোগ থাকে, এ ক্ষেত্রে সেই অবকাশ নেই— সম্পদ যেখানে আছে সেখানেই তাকে উদ্ধার করা দরকার। সুতরাং স্থানীয় বসতি ও ভূপ্রকৃতির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে গেলে ওই সম্পদ ব্যবহার করাই যাবে না। কিন্তু সেই কারণেই পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্নটিও বিশেষ মাত্রা অর্জন করে। যাঁদের জীবন ও জীবিকা এই প্রকল্পের ফলে বিপর্যস্ত হবে, তাঁদের জন্য বিকল্প আবাসন, নতুন কাজ এবং যথাযথ সামাজিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করা জরুরি। আর্থিক ক্ষতিপূরণ তার একটি অঙ্গ, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনের এক বিশদ পরিকল্পনাও আবশ্যক।

এই দায়িত্ব পূরণে প্রশাসন তথা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা যথেষ্ট তৎপর না হলে পরিণাম কী হতে পারে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ইতিহাস তার সাক্ষী। রাজ্যের বর্তমান শাসকরা দৃশ্যত সেই অভিজ্ঞতা মনে রেখেছেন। এক দিকে, উচ্ছেদ বা অস্থিরতার মাত্রা কমানোর জন্য তাঁরা প্রকল্পের পরিধি ও চরিত্র সংশোধন করেছেন, খোলামুখ খনির বদলে আপাতত ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ খননের পরিকল্পনাতেই উদ্যোগ সীমিত থাকছে। অন্য দিকে, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বহুমাত্রিক পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। তবে এই পরিকল্পনাগুলি সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ ভাবে রূপায়ণ করা দরকার। আশা থাকল, কেবল গোড়ায় নয়, আগাগোড়া প্রশাসন সে কথা মনে রাখবে। বৃহত্তর সমাজের দায়িত্বও অনস্বীকার্য— নিছক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দাবিতে অথবা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নেতিবাচক আন্দোলন অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু প্রশাসনের তরফে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে এবং তাঁদের বাস্তব সমস্যাগুলি আন্তরিক ভাবে অনুধাবন করে পুনর্বাসনের পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের ধারাটি বহাল রাখাও আবশ্যক। নিশ্চিত করা আবশ্যক যে, এই আলোচনা ও বোঝাপড়ার প্রক্রিয়াটিতে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের তরফে কোনও ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি বা ভীতিপ্রদর্শনের চেষ্টা যেন না হয়। প্রশাসনকে একই সঙ্গে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা এবং বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা দিতে হবে। কঠিন পরীক্ষা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Economy Deucha Pachami Coal Block

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy