কিশোরীগঞ্জ মনমোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দু’দশকের ‘প্রথা’ মেনে হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিল। তারা খাচ্ছিলও আলাদা জায়গায় বসে, আলাদা বাসনে। অর্থাৎ, হিন্দুরাষ্ট্রের যে স্বপ্ন উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতি দেখে আসছে, এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেকলমেই তার অনুশীলন চলছিল। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে বিস্তর তোলপাড় হল— রাতারাতি সব ধর্মের পড়ুয়া এক পঙ্ক্তিতে বসে খেতে আরম্ভ করল। কিন্তু সেই তোলপাড় এত দিন কেন হয়নি, বিদ্যালয়ের পরিসরে সর্বসম্মতিক্রমে কী ভাবে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেই চলছিল, প্রশ্ন আসলে এগুলিই। এবং, কারও যদি আশঙ্কা হয় যে, কিশোরীগঞ্জ মনমোহনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ই একমাত্র স্কুল নয় যেখানে এ-হেন অন্যায় সংঘটিত হয়ে চলেছে, তবে তাঁকে আশ্বস্ত করা মুশকিল। এই স্কুলের খবরটি প্রকাশিত হওয়ার আগে অবধি তো জানা ছিল না যে, এখানে এই অনাচার চলছে।
ঘটনাটি ভয়ঙ্কর কেন? প্রাক্-কৈশোরেই শিশুর ব্যক্তিত্ব, বোধবুদ্ধি, সমাজ সচেতনতা গড়ে উঠতে শুরু করে। ভবিষ্যতে তারা কেমন নাগরিক হবে, ভারত নামক ধারণাটিকে তারা কী ভাবে চিনবে বা আদৌ চিনবে কি না, তা বহুলাংশে নির্ধারিত হয় প্রাক্-কৈশোরের এই মুহূর্তটিতে। এমনই এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে অভিভাবক, শিক্ষক, এবং সার্বিক ভাবে সমাজের পরিচালকরা তাদের মনে বিষবৃক্ষ রোপণ করছেন। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং এই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতি বহুত্ববাদী সমাজে সাম্য, সম্প্রীতি ও একতা রক্ষা। সরকারি বা সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলি রাষ্ট্রীয় পরিসর। সেই পরিসরে যে এক দিনের জন্যও এমন বিভেদমূলক আচরণ চলতে পারে না, শিক্ষকদের সে কথা ভেঙে বুঝিয়ে বলতে হলে তাঁদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। মিড-ডে মিল নিয়ে আগেও রাজ্যগুলিতে বিবিধ বৈষম্যের ঘটনা স্তম্ভিত করেছে। পূর্বস্থলীর এই স্কুলটি নতুনতর দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।
এই অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। সংবাদপত্রে ঘটনার কথা প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতি হেঁশেল এক করে নিলেই যে নটে গাছটি মুড়োয় না, সে কথা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। বিদ্যালয়ের পরিসরটি ছাত্রছাত্রীদের মিলেমিশে বড় হয়ে ওঠার শিক্ষা দেয়। ধর্ম-জাতি-বর্ণের যে বিভাজিকাগুলি সমাজকে অন্ধকারে টেনে রাখে, বিদ্যালয় পরিসরে সেগুলি যাতে প্রবেশাধিকার না পায়, তা নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। তার বদলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে কঠোরতম শাস্তি পেতেই হবে। গত দু’দশক ধরে বিদ্যালয়ে যে এই প্রাচীর পোক্ত হচ্ছিল, বিদ্যালয় পরিদর্শনে সেই তথ্য ওঠেনি কেন? পরিদর্শন আদৌ হয়েছিল কি না, হলে কে বা কারা তথ্য আড়াল করেছিলেন, রিপোর্ট জমা পড়েছিল কি না, বা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি কেন— প্রতিটি ধাপ তদন্তসাপেক্ষ; এবং বিদ্যালয়ের কর্মী, পরিদর্শক, শিক্ষা দফতর, প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে হবে, এবং প্রয়োজনে দণ্ডের ভাগী হতে হবে। এমন যে কোনও ঘটনাকে প্রশাসনিক ও সামাজিক, দুই তরফেরই গভীর ব্যর্থতা হিসাবে দেখা দরকার। যদি এলাকার বাতাবরণে এমনই কোনও বিদ্বেষের মেঘ জমা থাকে, তবে ছাত্রদের স্বার্থেই অভিভাবকদের মন-সংস্কারের দায়িত্ব বিষয়ে সকল পক্ষকে সচেতন থাকতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)