পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা দিবস নিয়ে বিজেপির বিভেদের রাজনীতি যে থামার নয়, আরও এক বার স্পষ্ট হল এ বছর নববর্ষে। এমনিতে গত দু’বছর যাবৎ বঙ্গ বিজেপি নববর্ষের দিন তৃণমূল সরকার ঘোষিত বাংলা দিবস পালনের জোরদার বিরোধিতা করে আসছিলই; তাদের দলীয় ঘোষণায় পশ্চিমবঙ্গ দিবস হল ২০ জুন, ১৯৪৭-এ বাংলা বিভাজনের রূপরেখা যে তারিখে ভোটাভুটির ফলে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবে নববর্ষ বনাম ২০ জুন, এই আকচাআকচির মধ্যে রাজনীতির জল আরও ঘোলা হল বাংলার বাইরে, নববর্ষের দিনেই দিল্লির বিজেপি সরকারের কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-উদ্যোগ ঘিরে। নবগঠিত দিল্লি সরকারের সাহিত্যকলা পরিষদ এবং পর্যটন ও পরিবহণ উন্নয়ন নিগম নববর্ষের দিনেই ‘বাংলা দিবস’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, নতুন মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দিয়ে তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞাপনও। শেষবেলায় সেই অনুষ্ঠান স্থগিত হয়েছে বঙ্গ বিজেপির আপত্তি ও চাপে, এমনই শোনা যাচ্ছে। বঙ্গ বিজেপির তরফে বলা হচ্ছে, দিল্লির বিজেপি সরকার মোটেই নববর্ষে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের পরিকল্পনা করেনি, ওটা ভুয়ো খবর। আবার দিল্লির বিজেপি সরকার বলছে বঙ্গ বিজেপি ভুল বুঝেছে, ওই অনুষ্ঠান নেহাত পয়লা বৈশাখকে সম্মান প্রদর্শন বই বেশি কিছু নয়।
বঙ্গ বা দিল্লি— কোন বিজেপি ঠিক, কে-ই বা ভুল, বা তালেগোলে কেউ নিজেদের পোস্টেই গোল করে দিল কি না, এ সব পেরিয়ে আসল কথাটি হল বাংলা দিবস ঘিরে তাদের রাজনীতি। যে রাজনীতি— আরও এক বার বলে দেওয়া যাক— দাঁড়িয়েই আছে দেশভাগ ও বাংলা ভাগের ক্ষতকে রাজনৈতিক স্বার্থে খুঁচিয়ে ঘা করার উপরে। ছেচল্লিশের ভয়ঙ্কর দাঙ্গা পেরিয়ে আসার পর ধর্মের বিভাজনের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগ ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়, তারই সিলমোহর পড়ে ২০ জুন। বিজেপি বরাবর বলে এসেছে, বাংলা ভাগের পরিণাম আসলে হিন্দু বাঙালির ‘বেঁচে যাওয়া’, সেই পথেই স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরেও তাদের দলীয় রাজনীতির প্রাণভ্রমরা হল হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ। এই বিভাজনের লাভের গুড়ই তারা জনমত ও ভোটব্যাঙ্ক মারফত ঘরে তুলতে চাইছে, তুলছেও। ওয়াকফ নিয়ে ধর্মীয় সংঘর্ষে তেতে-ওঠা বঙ্গে, এবং ক্রমশ এগিয়ে আসা বিধানসভা নির্বাচনের বাজারে ২০ জুন-রূপী বিভেদের বড়িটি আরও এক বার গেলাতে পারলে মোক্ষম লাভ!
এই সমগ্র ছকে কোথাও বাঙালি, বাঙালিয়ানা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নেই, পুরোটাই হিন্দু বাঙালি, হিন্দু জাতীয়তাবাদের জগঝম্প। এর বিপ্রতীপে নববর্ষে বাংলা দিবস পালনের পিছনে রাজ্য সরকারের যুক্তিই ছিল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে ‘বাঙালি’ জাতি-পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা। তৃণমূল-বিজেপি দলমত-ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে দেখলে এ নিয়ে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না যে, নববর্ষই হতে পারে এই বঙ্গবাসীর ‘দেশের মাটি’কে শ্রদ্ধায় গর্বে পালন ও উদ্যাপন করার দিন। রাজ্য দিবস হিসেবে এমন একটি দিনই তো পালন করা উচিত যার গায়ে সম্মিলনের সৌরভ আছে, বিভেদের বেদনা নয়। এই আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিনটিই জাতি ও রাজ্যবাসী, দুই পরিচয়েই বাঙালির বরণীয়। বিভেদকামী রাজনীতি ক্রমাগত তাকে আক্রমণ করে যাবে, এ কথা মনে রেখেই তাকে আরও আঁকড়ে ধরা জরুরি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)