E-Paper

ভাল থাকার ঋণ

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার এখন এক রকম ‘অটোমেটেড’ বা স্বয়ংক্রিয়। অতএব, মানুষ তুলনায় কম ভেবে— কিছু ক্ষেত্রে হয়তো না-ভেবেই— ক্রেডিট কার্ডে খরচ করে।

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৬

আধুনিক অর্থব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই মহাজনকে পকেটে পুরে ফেলেছে। মহাজন, অর্থাৎ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যাঁর কাছে ঋণ পাওয়া যায়। রূপ পাল্টে তিনি এখন মোটামুটি ৪৫ বর্গসেন্টিমিটারের প্লাস্টিকের টুকরো, যার নাম ক্রেডিট কার্ড। এবং, মানবসভ্যতার ইতিহাসে সব মহাজন সম্মিলিত ভাবে যত ঋণ দিয়েছেন, দুনিয়া জুড়ে ক্রেডিট কার্ড তা প্রায় প্রতি দিন দিয়ে থাকে। মহাজনের মতোই, ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারও ভয়ানক চড়া। এবং, দুনিয়া জুড়েই জমে উঠছে সেই মহাজনের ঋণের বোঝা। আমেরিকায় ক্রেডিট কার্ডের বকেয়ার মোট পরিমাণ ছাড়িয়েছে সওয়া এক লক্ষ কোটি ডলার। সে তুলনায় ভারত পিছিয়ে বটে, তবে এ বছর ভারতেও ক্রেডিট কার্ডের মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা। ক্রেডিট কার্ডে কেন ঋণের পাহাড় জমে ওঠে, তার সহজ উত্তর হল, এক বার টাকা বকেয়া পড়লে সুদের উপরে সুদ জমতে থাকে, এবং সেই চক্রবৃদ্ধি হার মোট ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে দ্রুত হারে। কিন্তু, আর পাঁচটি ক্ষেত্রের মতো এই প্রশ্নের ক্ষেত্রেও সহজ উত্তর দিয়ে গোটা ছবিটি বোঝা অসম্ভব। প্রশ্ন হল, ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও মানুষ ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করে কেন? আচরণবাদী অর্থশাস্ত্র বলবে, তার কারণ ‘ফাজ ফ্যাক্টর’। পকেট থেকে কড়কড়ে নগদ টাকা গুনে দিতে মানুষের মনে কিঞ্চিৎ কষ্ট হয়। কিন্তু, ক্রেডিট কার্ডে যে-হেতু টাকা গোনার বালাই নেই— এখন তো ‘পিন’ দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না, পিওএস যন্ত্রে কার্ডটি ঠেকালেই যথেষ্ট; অথবা ফোনের বিভিন্ন অ্যাপ এখন জমা রাখে গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, নিজে থেকেই পড়ে নিতে পারে কার্ডের ওটিপি— ফলে, এ পথে টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে মনোবেদনা কম হয়। অর্থাৎ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার এখন এক রকম ‘অটোমেটেড’ বা স্বয়ংক্রিয়। অতএব, মানুষ তুলনায় কম ভেবে— কিছু ক্ষেত্রে হয়তো না-ভেবেই— ক্রেডিট কার্ডে খরচ করে।

যে-হেতু ভাবতে হয় কম, ফলে অপ্রয়োজনীয় খরচের প্রবণতাও বাড়ে। হঠাৎ পছন্দ হয়ে যাওয়া কোনও পোশাক, অথবা কোনও পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই দামি রেস্তরাঁয় খেতে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ক্রেডিট কার্ড-ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সম্ভাব্য। যে-হেতু খরচ করার সঙ্গে সঙ্গেই টাকা মেটাতে হচ্ছে না, ফলে খরচ করার সময় টাকার কথা না ভাবলেও চলে। ক্রেডিট কার্ড-কেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি এই অবিবেচনা। এর পাশাপাশি রয়েছে অন্যদের জীবনযাত্রার প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার প্রবণতা। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, পড়শির জীবন দেখে চোখ টাটানোর অভ্যাসটি মানুষের মজ্জাগত। আজ সমাজমাধ্যমের যুগে সেই দেখার পরিধি বেড়েছে অকল্পনীয় ভাবে। আত্মীয়স্বজন থেকে বন্ধু, সহপাঠী, পরিচিত অথবা অপরিচিত ‘ইনফ্লুয়েন্সার’, সমাজমাধ্যমে প্রত্যেকের জীবনের আকর্ষক অংশগুলি সদা-উন্মুক্ত। দুর্দান্ত পোশাক থেকে সুসজ্জিত গৃহ-অভ্যন্তর, অত্যাধুনিক গাড়ি থেকে বিদেশের অপার্থিব অঞ্চলে কাটানো ছুটি— সবই এখন প্রত্যেকের চোখের, এবং আরও বেশি করে মগজের, সামনে। তার পুরোটা যদি না-ও বা হয়, তবু যত দূর ক্রেডিট কার্ডের সাধ্যে কুলোয়, তার পিছনে ধাওয়া করাই এখন অনেকের কাছে নিয়ম। সেটাই ভাল থাকার ‘শর্ট কাট’। ফল? জমে ওঠা ঋণের পাহাড়।

ভেবে দেখলে যা বিশুদ্ধ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়, দুনিয়া জুড়ে কোটি কোটি মানুষ তাকে অবহেলা করেন কী ভাবে? যে ঋণ পরিশোধের সাধ্য নেই, নিতান্ত শখ মেটানোর জন্য সে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন কেন? সে প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ভোগবাদের অভ্যন্তরীণ যুক্তিতে— বিভিন্ন আঙ্গিকের বিপণন মানুষকে বুঝিয়েছে, ভাল থাকার অর্থ হল আরও বেশি কিনতে পারা, আরও ভোগ করতে পারা। ক্রেডিট কার্ড সেই অসম্ভবকে সম্ভব করার হাতিয়ার। নগদ খরচ করার ‘যন্ত্রণা’ নেই, এখনই টাকা মেটানোর কথা ভাবার বাধ্যবাধকতা নেই— কিন্তু, পছন্দসই পণ্যটি কিনে ফেলতে পারলে তৎক্ষণাৎ ‘আনন্দ’-এর অনুভূতি আছে। মগজ থেকে নিঃসৃত হয় ডোপামিন নামক হরমোন। কিন্তু, সে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। ফের ডোপামিনের তাড়না তৈরি হয় অল্প সময়ের মধ্যেই, ফলে ফের পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বেরোয়। হরেক চাপে থাকা মানুষ এই খেলার পরিণতি বিবেচনা করার সাধ্য হারায়— তার মগজের ‘ব্যান্ডউইডথ’-এ সে হিসাব কুলোয় না। তাৎক্ষণিক ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করাই তার ‘নিয়তি’। এই ‘নিয়তি’ই বহু মানুষকে টেনে নিয়ে যায় বিপর্যয়ের অতলে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Credit Card Banking Service

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy