সাম্প্রতিক কালে কূটনৈতিক চাপ যেন পিছু ছাড়ছে না দিল্লির। গত মাসে কিনমিং-এ চিন, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে এমনিতেই উদ্বিগ্ন সাউথ ব্লক। তারই মাঝে অতি সম্প্রতি তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের শীর্ষ আধিকারিকের ঢাকা সফর চিন্তা বাড়াল ভারতের। জানা গিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের মুখ্য উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের সচিব। এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য— বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে তুরস্ক সমর্থিত দু’টি প্রতিরক্ষা শিল্পাঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত করা, যা আঙ্কারাকে ভারতের পূর্ব সীমান্তের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে। লক্ষণীয়, সামরিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে এত কাল মূলত চিনের উপরে নির্ভরশীল থাকলেও, উন্নত মানের ড্রোন এবং অন্যান্য অস্ত্র কেনার মাধ্যমে ২০২২ সালে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির শীর্ষ ক্রেতা হয়ে ওঠে ঢাকা। ফলে ইঙ্গিত স্পষ্ট— দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পাশাপাশি এ বার বাংলাদেশেও গভীর হচ্ছে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি।
ভারতের উদ্বেগের কারণ আছে বইকি। বিশেষত, যখন প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক তাদের বিদেশনীতিতে সামরিক শিল্প উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্যান-ইসলামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত করতে আগ্রহী। প্রসঙ্গত, এর্ডোয়ানের অধীনে তুরস্কে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জেরে সে দেশের সম্পর্কে টান পড়েছে ভারতের সঙ্গে। বেশ কিছু কাল ধরেই প্যান-ইসলামপন্থার শক্তিশালী প্রবক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট এর্ডোয়ান। এই মতাদর্শগত পুনর্বিন্যাসের ফলে ভূরাজনৈতিক ভাবে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় আরব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তুরস্ক। সৌদি-আমিরশাহির প্রভাব রোধে তাই পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো অ-উপসাগরীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সহযোগিতার বিকল্প খুঁজছে। সেই কারণে ভারতের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি সামরিক সংঘর্ষে পাকিস্তানকে ড্রোন-সহ সামরিক সরঞ্জামের সহায়তার পাশাপাশি ইসলামাবাদের সঙ্গে বিবিধ চুক্তিও সম্পন্ন করেছে তারা। অন্য দিকে, বাংলাদেশকে সামরিক সহায়তা ছাড়াও তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, বিশেষত জামায়াতে ইসলামী-কে আর্থিক তো বটেই, সামরিক-সহ অন্যান্য সরঞ্জাম সহায়তারও অভিযোগ উঠেছে। ফলে দিল্লির সরাসরি সামরিক প্রতিপক্ষ না হয়েও আঙ্কারার ইসলামাবাদ ও ঢাকার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা, ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিচ্ছে। বিশেষত যখন চিন এবংপাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সখ্যের জেরে এমনিতেই উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত। যে অঞ্চলটিকে ভারতের চিকেন’স নেক বলে অভিহিত করা হয়, চিন সফরের আগে সেই ‘শিলিগুড়ি করিডর’ নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের প্ররোচনামূলক উক্তি ভারতের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। শিলিগুড়ি করিডর-এর কাছাকাছি বাংলাদেশের লালমনির হাটে চিনের বিমানঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনাটিও নয়। এ-হেন কূটনৈতিক বেষ্টনীর মধ্যে এ বার আঙ্কারার ড্রোন কূটনীতি ভারতের জন্য বড় ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)