আগে শুধু স্বল্পবিত্তদের মধ্যে চাহিদা কমছিল, এখন উচ্চমধ্যবিত্তরাও চাহিদা কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন। আর এক প্রাক্তন গভর্নর, দুব্বুরি সুব্বারাও মনে করিয়ে দিয়েছেন অর্থব্যবস্থার ধারাবাহিক উন্নতির জন্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখার গুরুত্বের কথা। মনে রাখা প্রয়োজন, যখন তাঁরা কথাগুলি বলছেন, তার কিছু দিন আগেই জানা গিয়েছে যে, জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪ শতাংশে। বেসরকারি লগ্নির হার বাড়ছে না। ভারতীয় অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করেন, এমন যে কেউ এই দুই অর্থশাস্ত্রীর সঙ্গে সহমত হবেন যে, পরিস্থিতি ভাল ঠেকছে না। একটি ত্রৈমাসিকের ফলাফলের ভিত্তিতে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া চলে না, সে কথা সত্য— কিন্তু একই রকম সত্য এই কথাটি যে, সমস্যা শুধু এই ত্রৈমাসিকেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি, এই সমস্যার উৎপত্তি অতিমারির সময়েও নয়, তার আগে। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু দেখিয়েছিলেন যে, কোভিডের আগেই পর পর চার বছর ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম ছিল। দেখা গিয়েছিল, দেশ জুড়েই চাহিদার গতিভঙ্গ হয়েছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে উদ্বেগজনক হারে। অর্থাৎ, সমস্যাটি আকস্মিক বা পারম্পর্যহীন নয়, তা অর্থব্যবস্থার কাঠামোগত। অতএব, অর্থশাস্ত্রীদের এই উদ্বেগকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান খোঁজাই বিধেয়।
উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের ভোগব্যয়ের চাহিদাতেও টান পড়েছে, এই সংবাদটির প্রকৃত গুরুত্ব এইখানে যে, তা সমস্যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা বোঝায়। আসল উদ্বেগের প্রশ্ন মধ্যবিত্ত বা তার নিম্নবর্তী শ্রেণির চাহিদা। অর্থশাস্ত্রে এ কথা সুপরিচিত যে, যাঁর আয় যত বেশি, আয়ের অনুপাতে ভোগব্যয়ের পরিমাণ তাঁর ততই কম। উচ্চ আয়ের শ্রেণিতে বিলাস ব্যয়ের পরিমাণ বেশি, সে কথা অনস্বীকার্য— কিন্তু, তারও একটি সীমা থাকে। যাঁদের আয় কম, তাঁদের আয়ের বেশির ভাগ অংশই খরচ হয় ভোগব্যয় বাবদ। সেই শ্রেণির চাহিদা দীর্ঘ দিন ধরেই ধাক্কা খাচ্ছে। কিছু দিন আগে ভারতের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ফাস্ট-মুভিং কনজ়িউমার গুডস বা ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা সংস্থা বাজারে চাহিদার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। যে-হেতু সাধারণ মানুষই ভোগ্যপণ্যের বাজারের সিংহভাগ চাহিদা জোগান, এবং গত কয়েক বছর ধরে তাঁদের সীমিত আয় ক্রমে সীমিততর হয়ে উঠেছে, ফলে ভোগব্যয়ের বাজারটি ধুঁকছে। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ গঠিত হয় ভোগ্যপণ্যের বাজারেই, এবং অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় ভোগব্যয়ের মাল্টিপ্লায়ার এফেক্টই সর্বাধিক। অতএব, অর্থব্যবস্থার এই ঘাটতি বিষয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন দুই অর্থশাস্ত্রী; যদিও পথটি নতুন নয়, বহুআলোচিত। তাঁরা জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে কেবলমাত্র কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে। কারণ, ভারতের বেশির ভাগ মানুষেরই অর্থোপার্জনের একমাত্র পথ শ্রমের বাজার— পুঁজি বিনিয়োগ থেকে মুনাফা অর্জন করেন অতি সামান্য সংখ্যক মানুষ, বাকিরা বেতনভুক। কর্মসংস্থান ঘটলে, কাজের ক্ষেত্রে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি পেলে তবেই মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থ উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। এবং, একমাত্র সে ক্ষেত্রেই তাঁরা ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরেও কেনাকাটা করতে সক্ষম হবেন। প্রশ্ন হল, কর্মসংস্থান হবে কোন পথে? সরকারি চাকরি যে যথেষ্ট নয়, তাতে তিলমাত্র সংশয় নেই। কাজ তৈরি করতে হবে বাজারে। এবং, বাজারে তখনই নতুন চাকরি আসবে, যখন পণ্যের চাহিদা যথেষ্ট হবে। তার জন্য আবার মানুষের কাজ প্রয়োজন। এই বিষচক্র ভাঙার পথ সন্ধান করাই এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)