এ বছরের মতো শেষ হল কাঁওয়ার যাত্রার বাৎসরিক তাণ্ডব। শ্রাবণ মাস উপলক্ষে গঙ্গা থেকে জল আনতে পায়ে হেঁটে হরিদ্বার বা সুলতানগঞ্জের মতো জায়গায় যান ভক্তরা। গত কয়েক বছর যাবৎ যাত্রাপথের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কাঁওয়ার যাত্রা। কেন, এ বছরের ঘটনাক্রম লক্ষ করলেই তা স্পষ্ট হবে। যাত্রাপথে দোকানপাট, হোটেল ভাঙচুর, স্থানীয় মানুষকে সামান্য কারণে বা সম্পূর্ণ অকারণে প্রহারের মতো ঘটনা এখন নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বার প্রহৃত হয়েছেন এক সিআরপিএফ জওয়ান। পরিস্থিতি এমন যে, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, সামনের বছর কাঁওয়ার যাত্রার সময় তাঁরা দোকান বন্ধ রাখবেন। বাস্তবিক, ভিড় মাত্রেই বিপজ্জনক, এ কথা ভারতবাসী অভিজ্ঞতায় জানেন। ভিড়ের এক নিজস্ব মনস্তত্ত্ব আছে— আদৌ নীতিমান নন, এমন ব্যক্তিবিশেষও একা থাকলে সচরাচর যেমন আচরণ করেন না, ভিড়ের অংশ হিসাবে তুলনায় নীতিমান কোনও মানুষ অবলীলায় তার চেয়ে অন্যায়তর আচরণ করতে পারেন। ভিড়ের অংশ হিসাবে নিজেকে দেখার মধ্যে নিহিত থাকে একটি ‘ছাড়পত্র’— মানুষ ধরে নেয়, ভিড়ের অংশ হিসাবে কোনও অন্যায় করলে তাতে কঠোর শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। শুধু তা-ই নয়, ভিড়ের মধ্যে ব্যক্তির নিজস্ব নৈতিকতার স্খলিত বোধ স্খলিততর হতে থাকে। এবং ঠিক এই কারণেই যে কোনও ভিড়, যে কোনও জনসমাগমের বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল।
কিন্তু, তার পরও সব ভিড় নয় সমান। যোগী আদিত্যনাথ-শাসিত উত্তরপ্রদেশে হিন্দু পুণ্যার্থীদের ভিড় অন্য অনেক ভিড়ের চেয়ে আলাদা, অনেক বেশি বিপজ্জনক, অনেক বেশি আগ্রাসী ও হিংস্র— তার সহজ কারণ, এই ভিড় জানে যে, তার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির প্রশ্নহীন মদত রয়েছে। সেই মদতের বিভিন্ন রূপ। উত্তরপ্রদেশ সরকার, এবং তার দেখাদেখি উত্তরাখণ্ড সরকার ঘোষণা করেছিল যে, কাঁওয়ার যাত্রার পথে যে হোটেল-রেস্তরাঁগুলি পড়বে, তার বাইরে মালিকের পরিচিতিজ্ঞাপক কিউআর কোড লাগাতে হবে। সম্প্রতি এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল হওয়া মামলা প্রসঙ্গে বিচারপতি এম এম সুন্দরেশ ও বিচারপতি এন কোটেশ্বর সিংহের বেঞ্চ জানিয়েছে, নির্দেশটির আইনি ঔচিত্যের প্রশ্নে আদালত আপাতত ঢুকবে না। আদালতের নির্দেশ শিরোধার্য করেও বলা বিধেয় যে, মালিকের পরিচয়জ্ঞাপনের এই ফরমান সংখ্যালঘু মালিকদের পক্ষে অতি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ফরমানটি কিন্তু উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী কোনও দলের নয়— ধর্মনিরপেক্ষ দেশের একটি রাজ্যের সরকারের।
হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য এমন ফরমানের গুরুত্ব কতখানি, আদিত্যনাথরা তা বিলক্ষণ জানেন। প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে যোগী হুমকি দিয়েছেন, যাঁরা কাঁওয়ার যাত্রীদের দুর্নাম করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাঁরই নির্দেশে কাঁওয়ারিয়াদের উপরে হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হয়েছে; তাঁরই রাজ্যের থানায় ক্লান্ত কাঁওয়ারিয়াদের পদসেবা করেছেন থানার উর্দিধারী আধিকারিকরা। কাঁওয়ার যাত্রীদের যে কোনও বেয়াদবিই যে মাফ হবে, সে কথা বোঝাতে কোনও ত্রুটি থাকেনি। রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত এই ভিড় যে বেপরোয়া হবেই, তাতে সংশয়ের কোনও অবকাশ আছে কি? এবং, শুধু এই যাত্রার সময়েই তো নয়, গত কয়েক বছর ধরেই উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্র এ কথা বোঝাতে কোনও ত্রুটি রাখেনি যে, এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য আইন এক রকম, আরসংখ্যালঘুর জন্য আর এক রকম। কাঁওয়ার যাত্রাকে কেন্দ্র করে যা ঘটছে, এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তার কোনওটাইঅপ্রত্যাশিত নয়, ‘অস্বাভাবিক’ নয়— হিন্দু রাষ্ট্রে এমনটাহওয়াই দস্তুর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)