E-Paper

রাজনীতির মার

বাংলাভাষী মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক মানেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, এই ধারণা এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক নির্মাণ— হিন্দুত্বের রাজনীতি সুপরিকল্পিত ভাবে নিশানা করছে বাংলার শ্রমিকদের।

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৯

মহারাষ্ট্র বা ওড়িশার মতো রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের পুলিশি নিগ্রহকে রাষ্ট্রীয় হিংসা ছাড়া কী-ই বা বলা চলে? নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের বাংলাদেশে ছেড়ে আসার স্পর্ধা অকল্পনীয়। পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের উপরে এই আক্রমণ তিনি মানবেন না, বুধবারে কলকাতার পদযাত্রা থেকে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোন আইন, কোন বিধিতে এই রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের পুলিশ বন্দি করছে, কেড়ে নিচ্ছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, সেগুলিকে ‘জাল’ ধরে নিয়ে চূড়ান্ত হয়রানির পর বার করে দিচ্ছে রাজ্য থেকে, এমনকি দেশ থেকে? কোন সরকারি বিধির বলে দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের বাসস্থানের বিদ্যুৎ, জলের সংযোগ কেটে দেওয়া হচ্ছে? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও জানাচ্ছে যে, নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না ভারতের মুসলিম শ্রমিকদের। থানায় আটক রাখা, দেশ থেকে বহিষ্কার বিষয়ে আইন-বিধি, কিছুই মানা হচ্ছে না। পরিযায়ী শ্রমিক বিবিধ ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে যান, কিন্তু হিংসার এই প্রচণ্ডতা অভূতপূর্ব। বাংলাভাষী মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক মানেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, এই ধারণা এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক নির্মাণ— হিন্দুত্বের রাজনীতি সুপরিকল্পিত ভাবে নিশানা করছে বাংলার শ্রমিকদের। তার পিছনে নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণ স্পষ্ট।

কলকাতার পদযাত্রায় মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকের অপমান বাংলার অপমান, বাঙালির অপমান। তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েও বলা প্রয়োজন যে, পরিযায়ী শ্রমিকের এই বিপন্নতাও রাজনীতিরই নির্মাণ। পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা, তাঁদের রোজগার ও স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থাগুলি করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন (ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট, ১৯৭৯), সেগুলি প্রায় কোনও রাজ্যই যথাযথ ভাবে পালন করেনি। আইন অনুসারে অন্য রাজ্যে কর্মরত পরিযায়ী শ্রমিক, এবং সে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে থাকার কথা ছিল আর একটি স্তর, তা নিয়োগকারীর, অথবা শ্রমিক-ঠিকাদারের। যে বাণিজ্যিক সংস্থা পাঁচ জনের বেশি আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করছে, তার নথিভুক্তি দরকার। ভিন রাজ্যে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে যে ঠিকাদার, তাকেও নথিভুক্তি করতে হবে। এই আইন বাস্তবে অনুসরণ করলে কোনও শ্রমিকের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে নিয়োগকারী, বা মালিক-শ্রমিকের মধ্যস্থতাকারী সংস্থাকে তলব করা যেত। প্রশাসন নথিভুক্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়নি, তাই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকরা চিরকালই অপর রাজ্যে অতি সহজে ‘অপরাধী’ বলে প্রতিপন্ন হয়ে আসছেন। উন্মত্ত জনতা বা পুলিশের নিগ্রহে সর্বস্বান্ত, ক্ষত-বিক্ষত, এমনকি নিহত হয়েছেন, এমন দৃষ্টান্ত কম নয়। নিয়োগকারী শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা দেওয়ার দায় অস্বীকার করলে তার ফল কত ভয়ানক হতে পারে, তার সাক্ষী ছিল কোভিড লকডাউন।

মমতা দাবি করেছেন, ভিন রাজ্যের শ্রমিকরা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ। তাঁর দাবি অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, শ্রমিকদের সুরক্ষার আইনি পরিকাঠামো কি রাজ্যে প্রস্তুত? তাঁদের নিয়োগকারী সংস্থাগুলি কি নথিভুক্ত? কেরল পরিযায়ী মজুরের স্বার্থরক্ষায়, শ্রমিক পরিবারগুলির জন্য আবাসন, ক্রেশ প্রভৃতি তৈরিতে যতখানি সক্রিয়, পশ্চিমবঙ্গ তেমন নয়। অপর দিকে, বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের নথিভুক্তি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি— পোর্টালে নাম একুশ লক্ষের, যা বাস্তবের ভগ্নাংশ। অসরকারি মতে মালদহেরই অন্তত দশ লক্ষ শ্রমিক অন্য রাজ্যে যান, শ্রম দফতরে নাম লেখা আড়াই লক্ষের। আইন ও প্রশাসনিক সুরক্ষা-ব্যবস্থার এই শিথিলতা সর্বত্র, সব স্তরে। শ্রমিক-স্বার্থের প্রতি উদাসীন রাজনীতি বহু দশক ধরে এই সঙ্কট তৈরি করেছে। ধর্ম-বিদ্বেষী রাজনীতির মারের সামনে অসহায়তা তাই আরও বেশি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Politics Minority Bangladesh Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy