ভোটার তালিকা সংশোধন ইত্যাদি প্রসঙ্গে বর্তমান ভারতের গণতন্ত্রের হাল নিয়ে অনেক প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হচ্ছে। তবে কেবল গণতন্ত্র নয়, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সত্তাটিও বর্তমানে এক গভীর সঙ্কটে গ্রস্ত। সঙ্কটসঙ্কেতসমূহের অন্যতম— প্রাদেশিক আইনসভার আনীত বিল প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ। এই মামলায় ইতিমধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু রায়-পরবর্তী আপিলের সূত্রে বিষয়টি এখন আবার বিচারালয়ের অঙ্গনে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষোভের হেতু: গত এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির সিলমোহর পড়ার ক্ষেত্রে সময়ের একটি ঊর্ধ্বসীমা থাকা দরকার। সিলমোহর যদি যথাসময়ে না পড়ে, তবে স্বেচ্ছাকৃত বিলম্বের দায় পড়বে তাঁদের উপর, এবং সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার নিজ দায়িত্বে বিলটি আইনে পরিণত করতে পারবে।
সাংবিধানিক যুক্তিটি পরিষ্কার। ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে রাজ্য সরকার বিধানসভায় সাংবিধানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে বিল পাশ করে। সেই বিল যদি কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রাখে, তা হলে বিধানসভার কার্যপদ্ধতিই অর্থহীন হয়ে পড়ে, যা একটি গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে বাঞ্ছনীয় নয়, নৈতিকও নয়। সলিসিটর জেনারেল উবাচ: আইন যাতে অতিদ্রুত স্বল্প-বিবেচনায় পাশ না হয়, সেটা দেখতেই কেন্দ্রের এই সতর্কতা। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, সংসদে প্রায় নামমাত্র আলোচনাসাপেক্ষে, কিংবা বিনা আলোচনাতেই তড়িঘড়ি করে অতীব সুদূরপ্রসারী বিষয় যেমন কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ কিংবা নতুন শিক্ষানীতি সংক্রান্ত আইন পাশ হয়েছিল। বিরোধী সাংসদদের মতামত না শুনেই একের পর এক আইন পাশ হয়েছে। সে যা-ই হোক, রাজ্যের বিধানসভার পাশ করা বিলে কেন্দ্রের ‘ইনঅ্যাকশন’ বা পদক্ষেপ না করার সচেতন ইচ্ছা দ্বারা সংবিধানসম্মত কর্মধারাকে রোধ করার চেষ্টাটিকে অবৈধ হিসাবেই দেখতে হবে— এটাই সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য। স্বাভাবিক ভাবেই, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকার এই বক্তব্য মোটেই পছন্দ করেনি, বিশেষত যখন আলোচনাটি উদ্ভূত হয়েছে কেরল, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি বিরোধী-শাসিত রাজ্য প্রসঙ্গে। কেরলের আইনজীবী যথার্থ বলেছেন, কেবলমাত্র বিরোধী-শাসিত রাজ্যেই এ ভাবে বিল আটকানো হচ্ছে। অস্যার্থ, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতেই সর্বদা ও সর্বথা ‘সুবিবেচনা’ বিরাজমান, অন্যত্র নয়।
কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ ছাড়াও আর একটি প্রশ্ন আছে। রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতি, দু’টি পদই ভারতীয় সংবিধানমতে আলঙ্কারিক, যাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি থাকে না। এ দেশে এই নীতি থেকে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতিদের অনেক বার ভ্রষ্ট হতে দেখা গিয়েছে, তবে ২০১৪ থেকে যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অ্যাজেন্ডা’ রূপায়ণে প্রকাশ্যত, প্রত্যক্ষত, দ্বিধাহীন ভাবে তাঁদের ‘কাজে লাগানো’ হয়েছে, এমন ধারাবাহিক অসাংবিধানিকতা ভারত আগে দেখেনি। রাজ্য সরকারের বিল প্রসঙ্গেও সেই কথা প্রযোজ্য। কত দূর রাজনৈতিক লক্ষ্যে এই পদগুলি ব্যবহার করা যায়, তারই যেন প্রদর্শন চলছে। এত সমালোচনা, বিরোধিতা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার প্রবল স্পর্ধা ও নির্ভয়তার সঙ্গে বিরোধীশাসিত রাজ্যের মতামত অগ্রাহ্য করে চলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধীশাসিত রাজ্যে রাজ্যপাল প্রায় প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনৈতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বও প্রেক্ষিতনির্ভর, বুঝতে অসুবিধা নেই। এক দিকে রামমন্দিরের মতো প্রশ্নে কেন্দ্র পূর্ণত সুপ্রিম কোর্টের প্রতি তন্নিষ্ঠ, অন্য দিকে কেন্দ্রবিরোধী রায়ের ক্ষেত্রে বিজেপি সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিষয়ে অতীব রুষ্ট। মূল কথা, গণতন্ত্রে শাসক-বিরোধী সকলকেই শাসনবিভাগের সঙ্গে বিচারবিভাগের সাযুজ্য মানতে হবে। এটা কোনও পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়, সাংবিধানিক বাধ্যতার প্রশ্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)