আজকের ভারতে কেবল গণতন্ত্র নয়, যুক্তরাষ্ট্র নিয়েও সঙ্কট গোড়ায় চারিয়ে গিয়েছে। কোনও রাজ্যে বিধানসভায় বিল রাজ্যপালের কাছে এবং তৎসূত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য এসে অনির্দিষ্ট কাল পড়ে থাকতে পারে কি না, সেই তর্কে বেশ কিছু কাল যাবৎ তীব্র টানাপড়েন চলছে কেন্দ্র ও রাজ্যসমূহের ভিতরে— যার মধ্যে প্রধান অবশ্যই বিরোধীশাসিত পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু। সমস্যাটি মূলত কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক দ্বৈরথের সমস্যা, এবং রাজ্যপালের ভূমিকা সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিস্বরূপ। তামিলনাড়ুতে একটি মামলা শুরু হয় সেখানকার বিধানসভায় পাশ হওয়া দশটি বিল রাজ্যপাল ফেলে রেখেছেন বলে। সেই মামলায় ৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, এ কাজ অন্যায়, বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে তিন মাসের মধ্যে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতিকে অনুমোদনের সিলমোহর দিতে হবে। স্বভাবতই এই রায় শোনার পর কেন্দ্রীয় সরকারের বিরক্তি প্রচ্ছন্ন থাকেনি। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চেয়েছিলেন— যার পারিভাষিক নাম ‘প্রেসিডেনশিয়াল রেফারেন্স’, যার মূল বক্তব্য ছিল, এই বিষয়ে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির ভূমিকার সংবিধানসম্মত পুনর্ব্যাখ্যা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মতামতের উপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে প্রেসিডেনশিয়াল রেফারেন্স মামলার শুনানি চলেছে সদ্য-প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি গাভাই-এর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যযুক্ত সাংবিধানিক বেঞ্চে। অতঃপর নভেম্বরের শেষে মাননীয় প্রাক্তন বিচারপতির কর্মসময়ের শেষ লগ্নে সেই সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় প্রকাশিত হল যে, রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য কোনও সময়সীমা ধার্য করা যাবে না। অবশ্যই সঙ্গে রইল একটি আশ্বাস, অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিল ফেলে রাখাও বাঞ্ছনীয় নয়। যদি তা রাখা হয়, মাননীয় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির সতর্কবার্তা: দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা মেনে নিতে পারে না।
বিষয়টি অতীব গুরুতর, কেবল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের দিক দিয়ে নয়, গণতন্ত্রের প্রেক্ষিতেও। কোনও রাজ্যে নির্বাচিত সরকারের তত্ত্বাবধানে বিধানসভায় যদি কোনও বিল পাশ হয়, তার মধ্যে গণতান্ত্রিক নীতির প্রতিফলন সহজেই বোধগম্য। গণতন্ত্র-মতে তা সেই রাজ্যে প্রযুক্ত হওয়াই ন্যায্য ও সাংবিধানিক। কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি থাকলেও। সংবিধানের বিভিন্ন ধারার মধ্যে নানা অস্পষ্টতা স্বাভাবিক, কেননা সব রকমের সম্ভাব্য ঘটনা আগে থেকে ভেবে নিয়ে অবস্থান গ্রহণ সহজ কাজ নয়। সে ক্ষেত্রে সংবিধানের মূলনীতিগুলি নির্দেশিকা হিসাবে কার্যকর, ধরে নিতে হবে। এবং সেই অনুসারে গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে— সুপ্রিম কোর্টের এপ্রিল মাসের রায়ে যা স্পষ্টত, দ্বিধাহীন ভাবে প্রকাশিত। অনেক দিক দিয়েই ভারতীয় গণতন্ত্রের অবনমন ক্লেশকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, আইন পাশ বিষয়ে নতুন করে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ যুক্ত হলে তা অতীব দুর্ভাগ্যজনক— এবং সামগ্রিক ভাবে বিপজ্জনক।
প্রণিধানযোগ্য সর্বোচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চের উত্থাপিত প্রশ্নটি যে— সংবিধান অনুযায়ী কোনও রাজ্যপালের যা করা উচিত, তিনি যদি তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য না করেন, বছরের পর বছর কোনও বিল আটকে রাখেন, সে ক্ষেত্রে আদালত কী করবে? তাঁর নিষ্ক্রিয়তা খতিয়ে দেখবে না? রাজ্য সরকারেরই বা তখন কী করণীয়? মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতাই বা কী ভাবে রক্ষিত হবে? গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার দর্শন-মতে, এ ক্ষেত্রে আদালত এপ্রিল মাসের রায়ের সময়সীমা সরিয়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল নভেম্বর মাসে, তার অর্থ— ধরাবাঁধা কোনও সময়রেখা না ধার্য করে সাংবিধানিক পদাসীন ব্যক্তির নৈতিক ও সাংবিধানিক কর্তব্যবোধের উপর নির্ভর করা। বিচারবিভাগের এই সিদ্ধান্তের অভ্যন্তরীণ ন্যায়বোধ অনস্বীকার্য। তবে সেই বোধটি দেশের শাসনবিভাগের আছে কি না— বড় প্রশ্নচিহ্ন সেখানেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)