দুর্ভাগ্য, সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ এশিয়ায় অধিকাংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কে অবনতি ঘটেছে। ঈষৎ ব্যতিক্রম, ভুটান। সেই কারণেই ভারতীয়প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ওই দেশে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য ভারতের প্রতিশ্রুতিরই ইঙ্গিতবাহী। মোদীর সফরকালে ভারত ও ভুটানের মধ্যে সৌর-বিদ্যুৎ, সবুজ শক্তি, ‘বায়োমাস’, স্বাস্থ্য ও ওষুধ, এবং পেমা সচিবালয় সম্পর্কিত কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। উদ্বোধন হল ১০২০ মেগাওয়াটের নতুন দ্বিপাক্ষিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের (পুংটাসাংচু-২)। পাশাপাশি ভুটানকে কম সুদে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করল দিল্লি। এই কূটনৈতিক সদিচ্ছার অন্তর্নিহিত কারণ, পরিবর্তিত চিন-প্রভাবিত বিশ্বব্যবস্থায় ভারত এবং ভুটান উভয়ের কৌশলগত দুর্বলতা।
ভারত চিরকালই দক্ষিণ এশিয়ায় বাইরের শক্তির প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করে এসেছে। সেই সূত্রে পূর্ব হিমালয় সীমান্তবর্তী অঞ্চল ও ঝুঁকিপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন’স নেক সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টায় ভুটানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে ভারত। ফলে, ভারতের স্বাধীন ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ভুটানের বিদেশনীতি পরিচালিত হয়েছে দিল্লি দ্বারা, যদিও এই নীতি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাতিল হয় ২০০৭ সালে, যখন উভয় দেশ একটি নতুন বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই দ্বিপাক্ষিক পরিবর্তনগুলি ছাড়াও, সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শক্তির গতিশীলতায় বিবিধ পরিবর্তন দেখা গিয়েছে— এই অঞ্চলের অন্যতম শক্তি হিসেবে চিনের উত্থান, সাহায্যের অছিলায় ছোট রাষ্ট্রগুলিকে কুক্ষিগত করতে আগ্রাসী কূটনীতি এবং চিন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি। ভারতের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সূত্রে চিনা আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছে থিম্পুকেও, বিশেষত ডোকলামের বিতর্কিত অঞ্চলের কারণে। চিন ও ভুটান, উভয়েরই অমীমাংসিত ভূখণ্ডগত জটিলতার প্রেক্ষিতে ভারতের আশঙ্কা, ভুটান ডোকলাম মালভূমি চিনের হাতে সঁপে দিলে চিকেন’স নেক করিডর আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে। অন্য দিকে, ভুটানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাও কম নয়। দীর্ঘ অমীমাংসিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা এবং সামান্য অর্থনৈতিক বৈচিত্র বেকারত্ব বাড়িয়েছে দেশের। ফলে সেখানকার বহু নাগরিক, বিশেষত নবীন প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। ভারতের উপর অতি-নির্ভরতা নিয়ে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও তরুণদের একাংশের প্রশ্ন তোলা অস্বাভাবিক নয়।
এই পরিস্থিতিতে ভুটানের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করা ছাড়া পথ নেই দিল্লির। ভারত কী ভাবে এই সমস্যাগুলির মোকাবিলা করে, তা নির্ভর করবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর। চিনের ক্রমবর্ধমান প্রতাপে ও প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় আধিপত্য এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। গণতান্ত্রিক নেপালে চিনের প্রভাব বৃদ্ধি এবং সে দেশে চ্যালেঞ্জগুলি থেকে শিক্ষা নিতে হবে দিল্লিকে। বুঝতে হবে, গণতান্ত্রিক ভুটান তার তরুণদের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ভুটানের তরুণদের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তার কৌশলগত স্বার্থকে একীভূত করাই এই মুহূর্তে দিল্লির অন্যতম কার্যকর বিকল্প।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)