E-Paper

বিপর্যয়ের শুরু?

এক দিনে ৪০০ মিলিমিটারের বর্ষণের ধাক্কা সইতে হয় যে অঞ্চলকে, তার পরিস্থিতির ভয়াবহতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। অসমের বরাক উপত্যকা সম্প্রতি সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৫ ০৫:৩১

বর্ষার শুরুতেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তছনছ উত্তর-পূর্ব ভারত। আট রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ ডুবেছে বন্যার ঘোলা জলে। এক দিনে ৪০০ মিলিমিটারের বর্ষণের ধাক্কা সইতে হয় যে অঞ্চলকে, তার পরিস্থিতির ভয়াবহতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। অসমের বরাক উপত্যকা সম্প্রতি সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন। শুধুমাত্র অসমে এই বছর বন্যায় মৃত্যুর সংখ্যা কুড়ির কাছাকাছি। একুশটি জেলা এখনও জলের তলায়। অন্তত ছ’লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টি এবং ভূমিধসের কারণে অরুণাচল প্রদেশে মৃত্যু হয়েছে বারো জনের। চার দিনের প্রবল বৃষ্টিতে মণিপুরের অন্তত কুড়ি হাজার বাসিন্দা গৃহহারা। মণিপুরের অবস্থাটি বিশেষ ভাবে শোচনীয়, কারণ রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও রাজ্যটি গত দু’বছর এক অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছে। জাতিহিংসায় দীর্ণ রাজ্যটিতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে। কিন্তু ধ্বংসের চিহ্ন এখনও সর্বত্র বিরাজমান। বহু মানুষ আজও আশ্রয়শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় জনজীবনে মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। মণিপুর ভাল নেই।

ভাল নেই উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যগুলিও। গত বর্ষায় তুমুল বৃষ্টিজনিত বন্যা এবং ভূমিধসের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছিল ত্রিপুরা। প্রাণহানি হয়েছিল অন্তত ছাব্বিশ জনের। পাহাড়ি অঞ্চলে স্বল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিতে ভূমিধস, হড়পা বান— অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিপর্যয়ের এটিই একমাত্র কারণ নয়। বিগত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পার্বত্য অঞ্চলে ঘটা বিপর্যয়গুলি চরিত্রগত ভাবে অনেকটাই কাছাকাছি, যার পিছনে মানুষের, বিশেষত সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম অনেকখানি দায়ী। উত্তর-পূর্ব ভারত অবস্থানগত ভাবেই বন্যাপ্রবণ। কিন্তু সেই অঞ্চলে যদি বিপুল পরিমাণে সবুজ উধাওয়ের কর্মযজ্ঞ চলে, তবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে কোন পথে? নদীর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ নির্মাণ, উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে একের পর এক বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে রাখা, বাঁধের পিছনে জমতে থাকা পলি, বালির কারণে ভরাট হয়ে আসা নদীখাত, নিয়মিত ড্রেজিং করে নদীখাত মুক্ত রাখার উদ্যোগে ঘাটতি— শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতই নয়, দেশের সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলের ঘন ঘন দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়াকে বিচার করতে হবে এর পরিপ্রেক্ষিতেই।

এই অবিমৃশ্যকারিতারই মূল্য চুকিয়ে চলেছে আরও এক পার্বত্য রাজ্য— সিকিম। গত তেইশ বছরে চোদ্দোটি সরকারি রিপোর্ট, এবং বিশেষজ্ঞদের সাবধানবাণী ছিল— অস্থির পূর্ব হিমালয়ে নির্মিত বৃহৎ বাঁধগুলি হিমবাহের গলনের কারণে বিপদের মুখে পড়তে পারে। তিস্তায় ভয়ঙ্কর প্লাবনের আশঙ্কার কথাও শোনানো হয়েছিল। সেই প্লাবন সিকিম চাক্ষুষ করেছে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে, যাতে চুংথাং-এ বাঁধ ভেঙে কার্যত ধুয়ে গিয়েছিল উত্তর সিকিমের বিরাট অংশ। তার পরও হুঁশ ফেরেনি সিকিম সরকারের, দিল্লিরও। সিকিমে বাঁধ নিয়ে তাদের অবস্থান পূর্ববৎ রয়েছে, বর্ষায় বিপদসঙ্কুল উত্তর সিকিমের পথে পর্যটনেও নিয়ন্ত্রণ আসেনি। দিনকয়েক আগে ফের সেই উত্তর সিকিমের লাচেনে প্রবল বৃষ্টিতে ধস নেমে মারা গিয়েছেন সেনাশিবিরের তিন জন। মুনসিথাং-এ গাড়ি খাদে পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন আট পর্যটক। জলবায়ু পরিবর্তনের মার আর সরকারের ভ্রান্ত নীতি— উভয়ের মূল্য চুকিয়ে চলেছে ভারতের পাহাড়ি জনপদগুলি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Heavy Rain North East sikkim Assam Manipur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy