E-Paper

ভিন্ন মতের জয়

মুসলমান পিতা ও হিন্দু মাতার মার্কিন নাগরিকত্ব-অর্জনকারী অভিবাসী সন্তান পশ্চাৎপদ সমাজকে আশার বার্তা দিতে পারেন।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৫

আর্নল্ড টয়েনবি বলেছিলেন, এক কালের নতুন স্বপ্ন-দেখানো বিপ্লবী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নিজেরই আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্বের কারণে ক্রমশ পরিণত হয়েছে সঙ্কীর্ণ রক্ষণশীল দেশে। এক অন্য সময়, অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর এই উক্তি, কিন্তু বর্তমান সময়েও এই আর্ষ উক্তির গুরুত্ব অনুভব করা সম্ভব। গত বুধবার নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনে তরুণ প্রার্থী জ়োহরান মামদানির জয়সংবাদ আবারও তা মনে করিয়ে দিল, কেননা মামদানির জয়ই প্রমাণ করে, ওই সঙ্কীর্ণ রক্ষণশীল আমেরিকার নেপথ্যে, প্রচ্ছন্নে, উদারবাদের স্বপ্ন-দেখানো আমেরিকা এখনও অস্তিত্বশীল। মামদানি এই জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র। এ কেবল একটি মহানগরের মহানাগরিক নির্বাচিত হওয়ার গৌরব নয়, গণতন্ত্রের বিলুপ্তপ্রায় মূল্যবোধ ও নিবন্ত প্রদীপকে অন্তত কিছুটা উস্কে দেওয়ার কৃতিত্ব। এই কারণেই তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা নিউ ইয়র্ক ছাপিয়ে ছড়িয়ে যায় গোটা আমেরিকায়, এবং দূরদূরান্তে দেশে-মহাদেশে। এ কোনও বামপন্থা বা সমাজতন্ত্র বা বর্ণবিদ্বেষবিরোধ বা ইসলামবিদ্বেষ-প্রতিরোধের একমাত্রিক কাহিনি নয়, বরং কর্তৃত্ববাদ, স্বৈরতন্ত্র, পুঁজিস্বার্থ ও বিদ্বেষবিষ জারিত সময়ে আবার প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের মঞ্চে বিরুদ্ধস্বরের জয় পাওয়ার কাহিনি। ভরসা মেলে যে, মামদানিরা উঠে আসেন এই আপাত-বিদ্বেষক্লিষ্ট ভুবনের মধ্যেই। যে আমেরিকা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতায় মাতে, সে দেশের প্রকৃত পরিচিতি অভিবাসন-জাত বহুসংস্কৃতিতে। তাই মুসলমান পিতা ও হিন্দু মাতার মার্কিন নাগরিকত্ব-অর্জনকারী অভিবাসী সন্তান পশ্চাৎপদ সমাজকে আশার বার্তা দিতে পারেন।

বাস্তবিক, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে অসহিষ্ণু উদারবাদ-বিরোধিতা, অভিবাসনবিরোধিতা ও ইসলামোফোবিয়া ও দেশে এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে পুরনো ধারার রক্ষণশীলরাও অনেকে ক্ষুব্ধ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সর্বশক্তিতে মামদানির প্রচারের বিরোধিতা করেছেন, প্রচার আটকাতে বহু লক্ষ ডলার ব্যয় করেছেন, প্রায় সব কর্পোরেট সংস্থা মামদানির বিরুদ্ধপ্রার্থীর পিছনে অর্থসম্ভার ঢেলে দিয়েছে, প্রায় সব বৃহৎ প্রচারমাধ্যম তাঁর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে নিম্নরুচির ন্যক্কারজনক প্রচার চালিয়েছে। এই তীব্র শিবির বিভাজনের প্রধান দু’টি কারণ, এক, প্যালেস্টাইন-ইজ়রায়েল প্রশ্ন— মামদানি কেবল মুসলমান নন, ইহুদি-ক্ষমতা অধ্যুষিত নিউ ইয়র্কে তিনি ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইন-নীতির তীব্র সমালোচক। দুই, তাঁর নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় আছে দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্তমুখী সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব, যেমন করব্যবস্থায় পরিবর্তন, খাদ্য-নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন, দরিদ্রের বাসস্থান সমস্যার দ্রুত নিরাময় ইত্যাদি। এই সামাজিক ন্যায়ের দাবিগুলি চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চোখে অসহনীয়। সুতরাং নিশ্চিত ভাবেই তীব্র প্রতিরোধের সামনে পড়তে চলেছেন মেয়র মামদানি। ইতিমধ্যেই ফেডারাল ফান্ডিং ও বেসরকারি সহায়তা বন্ধের হুমকি শোনা গিয়েছে।

প্রসঙ্গত, নিউ ইয়র্কের নতুন মেয়র ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান পিতা ও হিন্দু মাতার সন্তান, তবু এ নিয়ে ভারতে উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য রকমের কম, কেননা জ়োহরান মামদানি ঘোষিত ভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরোধী। এমনিতে কোনও শহরের মেয়রকে নিয়ে আলাদা সরকারি উচ্ছ্বাসের কারণ নেই, তবু সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গিয়েছে, ব্রিটেন বা অন্যত্র ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তির প্রশাসক নির্বাচিত হওয়ার ঘটনায় ভারতের জনোল্লাস। আসল কথা, কেবল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই তো এক গভীর সঙ্কীর্ণমনা দেশ লুকিয়ে নেই, ভারতেও এখন বিদ্বেষবাদ ও কর্তৃত্ববাদেরই রমরমা। বিরুদ্ধমত পেষণ-কারী নব্য গণতন্ত্রের সুতোয় আমেরিকা ও ভারত দুই দেশই বাঁধা। এই পরিস্থিতিতে, ভারতের বিরোধী রাজনীতিও আশ্বস্ত ও আশাবাদী বোধ করতে পারে— এ ভাবেও ফিরে আসা যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america new york

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy