রাজস্থানের সরিস্কা টাইগার রিজ়ার্ভ-এ নতুন করে ‘কোর এরিয়া’র সীমানা নির্ধারণের পরিকল্পনাটি কার্যকর হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র। আধিকারিকরা এই পদক্ষেপকে ব্যাখ্যা করেছেন সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা এবং আর্থিক স্বার্থরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক যুক্তিসঙ্গত উদ্যোগ বলে। কিন্তু তা নিতান্তই সরকারি কেজো ভাষ্য। বাস্তব বলে, এই দেশে পরিবেশ রক্ষা এবং সরকারের উন্নয়ন-ধারণা কখনও এক সুরে বাজে না। সরিস্কার ক্ষেত্রেও তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এই জঙ্গলের ‘কোর এরিয়া’র সীমানার এক কিলোমিটারের মধ্যেই মার্বেল, ডলোমাইট, চুনাপাথর প্রভৃতি খনি অবস্থিত। নতুন করে সীমানা নির্ধারণের প্রস্তাবটি চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেলে এমন পঞ্চাশটিরও বেশি খনিতে নতুন করে প্রাণসঞ্চার হবে, যে খনিগুলির কাজকর্ম গত বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশিকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, ভারসাম্য রক্ষার অজুহাত অরণ্যটিকে নতুন বিপদের মুখে ঠেলে দেবে, তেমন আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
এই অরণ্যে বাঘের বাসভূমিতে হানাদারি এই প্রথম নয়। বছর কুড়ি আগে এই টাইগার রিজ়ার্ভ-এ চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যে বাঘের সংখ্যা নেমে এসেছিল শূন্যে। সেই অন্ধকার কাটিয়ে সরিস্কা এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি বাঘের আস্তানা। কিন্তু বিপদ কাটেনি। জঙ্গলের গভীরে মানুষ ও গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত ইতিপূর্বে এক স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে। ২০২৪ সালের মার্চে আদালত ‘সেন্ট্রাল এমপাওয়ারড কমিটি’কে নির্দেশ দেয় এই বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করতে। সিইসি-র রিপোর্টে বলা হয়েছিল— সীমানা নির্ধারণের কাজটি যথাযথ না হওয়াতেই অবৈধ খনির এমন রমরমা। অতঃপর সুপ্রিম কোর্ট গত ডিসেম্বরে রাজস্থান সরকারকে নির্দেশ দেয় আগামী এক বছরের মধ্যেই সীমানা নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে। রাজস্থান সরকার এই আইনি ফাঁককেই কাজে লাগিয়েছে। পরিকল্পনায় কোর এরিয়া-র ৪৮.৩৯ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি অঞ্চলকে সরিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে পার্শ্ববর্তী বাফার জ়োন-এর ৯০.৯১ বর্গকিলোমিটার জায়গাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু সরিস্কার ভূপ্রকৃতি এমন যে, কোর এরিয়া-র এই অংশটিকে বাদ দিলে তা বাঘ-সহ অন্য বন্যপ্রাণীদের এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র মসৃণ চলাচলে বাধার সৃষ্টি করবে। তা ছাড়া এই নতুন ভাবে চিহ্নিত অঞ্চলে খনিগুলিকে দেখানো হবে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে। সুতরাং, খনির কাজকর্ম অবাধ হবে। সমগ্র এলাকাতে বৃদ্ধি পাবে মানুষ, যানবাহনের সংখ্যা, বর্জ্যের পরিমাণ।
এই ঘটনা আরও এক বার প্রমাণ করে, যাঁরা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তাঁরা নিজেদের স্বার্থসীমার বাইরের সমস্ত কিছুকেই অবজ্ঞা, অসম্মান করতে সিদ্ধহস্ত। খনি শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা শীর্ষ স্তরের স্নেহধন্য বলেই শোনা যায়, ফলে তাঁদের স্বার্থরক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে গুরুতর বিবেচ্য। বন্যপ্রাণীদের ভোট নেই, টাকাও নেই— ফলে, তাদের স্বার্থ লঙ্ঘন করতে দু’বার ভাবার প্রয়োজন পড়ে না। সাঙাততন্ত্রের স্বার্থরক্ষায় নেতারা কিছু করতেই পিছপা নন— এমনকি, এই বিষয়ে শীর্ষ আদালতের নির্দেশটুকুকেও মান্যতা দেন না। তাই বিপদ শুধু সরিস্কারই নয়, বৃহত্তর অর্থে ভারতীয় গণতন্ত্রেরও বটে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)