মাসখানেকের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে গেল ‘বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অসুখটি। খাস কলকাতায়, শিয়ালদহ স্টেশনের কাছাকাছি জনাকয়েক দোকানদার কিছু ছাত্রকে হেনস্থা এবং নিগ্রহ করল, ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে। নিগৃহীত ছাত্ররা ধর্মে মুসলমান; নিগ্রহকারীরা অ-বাংলাভাষী— দুটো তথ্যের একটিও নিছক কাকতালীয় নয়। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যে আগুন নিয়ে খেলছে, এটি তারই স্ফুলিঙ্গ। সমাজ চালিত হয় বৈধতা নির্মাণের মাধ্যমে। কোনও আচরণ এক বার ‘বৈধ’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সমাজ তার অনুকরণ করতে থাকে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দিল্লি-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশে প্রশাসনিক উদ্যোগে বাঙালি-বিদ্বেষের যে বীজ বপন করেছিল, তারা নিশ্চিত ভাবেই জানত যে, সেই বিষবৃক্ষে সামাজিক বৈধতার ফল ধরতে সময় লাগবে না। (মুসলমান) বাঙালিমাত্রেই ‘বাংলাদেশি’, এই কথাটি দেশের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত জনসমাজ বিশ্বাস করে ফেলবে। হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষের কারবারিদের অঙ্ক বুঝতে ভুল হয়নি। একেবারে কলকাতার বুকেই কতিপয় ‘দেশভক্ত’ ‘বাংলাদেশি’ শনাক্তকরণের ‘জাতীয়তাবাদী কর্তব্য’টি পালন করে ফেলেছে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি হওয়া বিধেয়। এবং, এই বাংলার বুকে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টাকে তিলমাত্র জায়গা দেওয়া হবে না, সে কথাও দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে হবে। কাজটি একই সঙ্গে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক।
শিয়ালদহে বাঙালি নিগ্রহের পিছনে প্রশাসনের মদত ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, বাঙালির মাতৃভূমিতে কিছু লোক নির্দ্বিধায় নিজেদের দেশের রক্ষাকর্তা, অভিভাবক ভেবে নিয়ে বাঙালি-নিগ্রহ করতে সাহস পেয়েছে। কথাটা সাধারণ নয়। বিজেপির হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের রাজনীতি খুব সচেতন ভাবে হিন্দিভাষী হিন্দুকে অন্য সব ভারতীয়ের তুলনায় উচ্চতর অবস্থানে স্থাপন করতে চেয়েছে। হিন্দি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই প্রকল্পটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক— কারণ, অভিজ্ঞতা বলছে, অ-হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির মাটিতে হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটে অনেক কম গতিতে, অনেক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে তুমুল মোদী-ঝড়েও হিন্দুত্ববাদ প্রশ্নাতীত জয় অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদই সে রাজনীতির বিজয়রথের সারথি হতে পারে বলে হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রের বিশ্বাস। হিন্দির আধিপত্যকে বৈধ করে তুলতে পারলে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে রাজনৈতিক জমি দখলের কাজটি সহজতর হবে, এমন সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়ারও উপায় নেই। শিয়ালদহের ঘটনাটিকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা বিধেয়।
নিগ্রহকারীরা তৃণমূল কংগ্রেসের এক স্থানীয় নেতার অনুগামী বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগটি সত্য হলে আশ্চর্য হওয়ার বিশেষ কারণ নেই— রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এ রাজ্যে সম্পূর্ণ। কিন্তু, সেখানেই নিহিত বৃহত্তর সমস্যাটি— জাতীয়তাবাদের মোড়কে হিন্দু-হিন্দি রাজনীতির বৈধতা এমন ভাবেই নির্মিত হয়েছে যে, রাজনীতির বাহ্যিক বিভেদ তার গতি রুদ্ধ করতে পারে না। সেই কারণেই, কেবলমাত্র প্রশাসনিক পথে এই সমস্যার সমাধান হবে না। শিয়ালদহে যারা বাঙালি নিগ্রহ করেছে, তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া প্রয়োজন; তৃণমূল যে-হেতু বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি করতে চাইছে, ফলে তাদের তরফে আরও বেশি সতর্কতাও প্রয়োজন। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্পের বিপ্রতীপে সর্বজনীনতার, অন্তর্ভুক্তির বয়ানকে করে তুলতে হবে একটি সদর্থক রাজনৈতিক প্রকল্প। ভারতীয়ত্ব যে কোনও একটি বিশেষ ভাষাভাষী বা বিশেষ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়, এবং কোনও অজুহাতেই যে কেউ জাতীয়তাবাদের লেঠেল হতে পারে না, এ কথাটি জনমানসে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্বেষের বিষ একেবারে গোড়া থেকে না তুললে তার থেকে মুক্তি নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)