—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
একটি শব্দবন্ধ অতিব্যবহারে জীর্ণ: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কটি যদিও প্রথমত স্বীকৃতির, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ক্ষমতার উচ্চাবচতার, সুতরাং ক্ষমতার অলিন্দ বেয়েই আসে রাষ্ট্রের অতি-ক্ষমতা, তার থেকে রাষ্ট্রের সন্ত্রাস। যাকে বলে, সিধে রাস্তা, গেলেই হল! বর্তমান সময় দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বিশ্বময় রাষ্ট্রের চরিত্র যেমনই হোক না কেন, এই রাস্তায় হাঁটার জন্য তার উদ্গ্রীবতা একই রকম তীব্র। স্বৈরতান্ত্রিক আকারে কার্যকর যে রাষ্ট্রক্ষমতা, তার থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ততখানি তফাত নেই, যতটা থাকার কথা ছিল। প্রথমের তুলনায় দ্বিতীয়ের সন্ত্রাস-প্রবণতা কম নয়, যদিও আকারে প্রকারে দ্বিতীয়ের সন্ত্রাস হয়তো আলাদা। এই নিয়ে রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরা ভাবছেন ও লিখছেন, ইতিহাসবিদরাও আলোচনা করছেন। বিশেষত সম্প্রতি কালে বিবিধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে উদ্ভূত কর্তৃত্ববাদের যে বাস্তব— তাতে তাঁদের সেই কাজ বিশেষ জরুরি হয়ে উঠেছে। গত দশকাধিক কালের ভারতীয় অভিজ্ঞতাও তাতে গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেই একই পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলতে পারে, গত অগস্ট মাসটি বঙ্গজীবনের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে রইল, এবং বিশ্বময় ঘূর্ণ্যমান রাষ্ট্রসন্ত্রাসের আখ্যানে একটি বিশেষ অধ্যায় রচনা করল। বাংলার পুবে ও পশ্চিমে, দুই অংশেরই রাষ্ট্রীয় জীবনে নেমে এল ভয়ঙ্কর সঙ্কটকাল। গণতান্ত্রিক পরিচয়ে অন্বিত রাষ্ট্রিক নেতৃত্ব প্রমাণ করে দিলেন যে, তাঁরা অবলীলায় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করতে পারেন, দুর্নীতিতে গ্রস্ত হতে পারেন, অন্যায়কে পোষণ করতে পারেন, অন্যায়কারী দুর্বৃত্তের তোষণ করতে পারেন। মনে করে নিতে পারেন যে তাঁদের পিছনে যে সমর্থন, তার আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে তাঁরা যত দূর ইচ্ছা যেতে পারেন, অনন্ত অবাধ তাঁদের দুর্নীতিপথ পরিক্রমা।
একেবারে মূলে গিয়ে হয়তো তাই প্রশ্ন তোলা যায়, তবে কি রাষ্ট্রক্ষমতাই সব নষ্টের গোড়া? যার হাতে শাসনের দণ্ড সমাজস্বীকৃত ভাবে অর্পিত হয়েছে, যার উপর ন্যস্ত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার, ব্যবস্থা চালানোর দায়, অন্যায় থামিয়ে ন্যায় বিতরণের দায়িত্ব, তাই যখন শোষিত শ্রেণি-গোষ্ঠী-সমাজ, কিংবা তুলনায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, কিংবা প্রান্তিক মানুষের নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, কে তাকে শাসন করবে, কার তত ক্ষমতা। তফাত কেবল, এক নিপীড়ক গোষ্ঠী গিয়ে আসে আর এক নিপীড়ক বাহিনী। এক শোষক শক্তির বদলে আর এক শোষক শক্তি। রাষ্ট্রের হাতেই পুলিশ, রাষ্ট্রের হাতেই অস্ত্র, রাষ্ট্রের হাতেই অর্থ। আর মানুষেরই কি অন্তর্লীন প্রবণতা নয় সেই সমস্ত সম্পদ এক বার হাতের নাগালে পেলে উন্মত্ত হার্মাদ হয়ে উঠে অপরের নিপীড়ন? সেই চিরপুরাতন বচনের কাছেই কি তবে ফিরে আসা, যে-ই যায় ক্ষমতায় সে-ই হয় নিপীড়ক?
এর থেকেও একটা ভয়ের কথা থাকতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা, কিংবা আইনের শাসন, এই শব্দবন্ধগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই ভয়। সেই ভয়— সামূহিক সামাজিক স্বীকৃতির। অন্যায়কারী অন্যায় করলে তাকে চিনে নেওয়া যায়, কিন্তু আইনের শাসন বে-আইন বা অপ-শাসনের পথে গেলে অনেক সময়ই তাকে চিনতে পারা যায় না, কিংবা চিনেও অসহায় ভাবে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করতে হয়। ভোলা কি যায় যে, রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল হেবিয়াস কর্পাস-এর মতো চেতনাও, যেখানে মানুষের অধিকারকে সম্পূর্ণত খর্ব করার অধিকার অর্পিত হয়েছিল রাষ্ট্রেরই হাতে। বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকে প্রমাণলোপ, সাক্ষী লোপাট, দীর্ঘসূত্রতার নামে বিচারের প্রহসন। সমাজবাদীদের একাংশ বলে আসছেন, এই জন্যই রাষ্ট্র বিষয়টারই বিলোপ চাই, রাষ্ট্রকে শুকিয়ে মারার পথ সন্ধানই নাকি জরুরি। কিন্তু সমাজকে পরিচালনা করার উপযুক্ত কোনও বিকল্পও এত দিন যখন উদ্ভাসিত হয়নি, বা যে বিকল্পের ভাবনা শোনা গিয়েছে, তা স্বপন-বয়নের মতো অধরা থেকে গিয়েছে— সেখানে কোন পথটি শ্রেষ্ঠ ও নিরাপদতম রাজপথ, আজও তা অজানা। এই বিরাট অজ্ঞানতার গহ্বর থেকে যদি ফিরে তাকানো যায় আজকের বঙ্গভূমির দিকে, তা হলে পড়ে থাকে একটি কথাই। শাসনের বিকল্প পদ্ধতি যদি জানা না থাকে, তা হলে প্রচলিত পদ্ধতির মধ্যেই শাসককে শাসনভার দিতে হবে। এবং সে ক্ষেত্রে শাসককে বোঝাতে হবে, অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করে যেতে হবে যে, এই পর্যন্তই, আর নয়! শাসকের কাছে ভিক্ষা নয়, অনুগ্রহ নয়, দাবিও নয়— বরং প্রতি মুহূর্তের সতর্ক প্রহরায় রাখতে হবে শাসককে, সেটাই একমাত্র পথ। আপাতত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy