এক মাসের বেশি বিচারাধীন বন্দি থাকলেই খোয়াতে হবে মন্ত্রিত্ব, এমন তুঘলকি সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনীতিটি প্রধানমন্ত্রী গোপন করার চেষ্টা করেননি। দমদমের জনসভায় স্পষ্ট জানিয়ে গিয়েছেন, যারা চোর, তারাই বিরোধিতা করছে এই সিদ্ধান্তের। এ দেশে মন্ত্রীরা চুরি করেন না বললে পাথরও অট্টহাস্য করে উঠবে। পুরনো ইতিহাস খুঁজলেও চুরির নজির মিলবে; নতুন ইতিহাসে কার্যত না খুঁজলেও মিলবে। ২০১৪ সাল থেকে গোটা দেশে মোট ২২ জন মন্ত্রী জেল খেটেছেন। সেই তালিকায় আছেন দু’জন মুখ্যমন্ত্রীও— তামিলনাড়ুর জয়ললিতা এবং দিল্লির অরবিন্দ কেজরীওয়াল। তালিকায় রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ মন্ত্রী। তাঁদের মধ্যে ফিরহাদ হাকিম এবং প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কারাবাসের মেয়াদ এক মাসের কম; পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং মদন মিত্রের মেয়াদ তার বেশি। তৃণমূল কংগ্রেস, আপ, এবং এআইএডিএমকে ছাড়াও জেল খাটা মন্ত্রীদের তালিকায় রয়েছেন ডিএমকে এবং এনসিপি-র সদস্যরা। উল্লেখযোগ্য যে, এই তালিকায় বিজেপিশাসিত রাজ্যের কোনও মন্ত্রী নেই। হতেই পারে যে, সে দলের নেতারা সবাই সৎ, আদর্শনিষ্ঠ— কিন্তু, তার চেয়ে এই সম্ভাবনা কি অনেক বেশি নয় যে, দুই প্রধান তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি শাসকের খাঁচার টিয়া হিসাবে খ্যাতিমান বলে তারা শাসক দলের দুর্নীতির ক্ষেত্রে দৃষ্টিশক্তি হারায়?
প্রশ্নটি জটিলতর হয়ে ওঠে অন্য একটি তথ্য সামনে এলে— ২০১৪ সাল থেকে এমন ২৫ জন রাজনীতিক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ২০২৪ সালে এক সংবাদপত্রের তদন্তমূলক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে তিন জনের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছে; আরও ২০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত তাঁদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই থিতিয়ে গিয়েছে, সিবিআই বা ইডির তরফে আর কোনও নড়াচড়া নেই। মাত্র দুই হতভাগ্য রাজনীতিক— কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যাওয়া জ্যোতি মির্ধা, এবং তেলুগু দেশম পার্টি থেকে বিজেপিতে যাওয়া ওয়াই এস চৌধরি— দল বদলেও নিস্তার পাননি, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত একেবারে থেমে যায়নি। তালিকায় থাকা বাকি নামগুলি যথেষ্ট ওজনদার। যেমন, অসমের হিমন্তবিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে সারদা কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত করছিল সিবিআই। তিনি বিজেপিতে গেলেন— তদন্তও সেই থমকে দাঁড়াল, তার পর এক দশকে এক চুলও অগ্রগতি হল না। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও দল পাল্টানোর পর থেকেই নিরাপদ— ২০১৯ সালে তিনি সাংসদ থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য লোকসভার স্পিকারের অনুমতি চেয়েছিল সিবিআই; ২০২০-তে শুভেন্দু দল পাল্টালেন, স্পিকার আজও তদন্তের অনুমতি দেননি। একনাথ শিন্দে থেকে অজিত পওয়ার, অশোক চহ্বাণ থেকে প্রফুল্ল পটেল, বিজেপির ছত্রছায়ায় আসামাত্র প্রত্যেকেই নিশ্চিন্ত হয়েছেন।
হতেই পারে, সবই সমাপতন— তাঁদের বিজেপিতে আসা এবং তদন্ত গতিহীন হওয়া কার্যকারণসম্পর্কহীন, নেহাত একই সঙ্গে ঘটেছে। ইডি বা সিবিআই যেমন জানিয়েছে যে, তদন্তের গতি নির্ভর করে নতুন তথ্যপ্রমাণ হাতে আসার উপরে। কিন্তু, এতগুলি সমাপতন এক সঙ্গে ঘটতে পারে, ‘দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’। বরং কারও সন্দেহ হতেই পারে যে, বিরোধীরা বিজেপিকে যে ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর তকমা দিয়েছেন, সেটি নেহাত অসার নয়। সিবিআই-ইডি হয়তো আর তদন্তকারী সংস্থা নেই, বিরোধী নেতাদের হয়রান করার যন্ত্র হয়ে উঠেছে মাত্র। প্রধানমন্ত্রী স্বভাবতই তাঁর ভাষণে এ সব প্রসঙ্গে ঢোকেননি। তবে কিনা, তিনি মনে রাখতে পারেন, জনগণের স্মৃতি ক্ষীণ বটে, কিন্তু এতখানিও দুর্বল নয় যে, এই সব ঘটনা সবাই ভুলে গিয়েছেন। কিসের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে তিনি বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলছেন, সেটা কারও চোখ এড়াচ্ছে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)