Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Madras High Court

দায়

সরকার যেখানে জনস্বার্থের কথা ভাবিতে অভ্যস্ত নহে, সেখানে স্বশাসিত সংস্থাগুলির দায়িত্ব বাড়ে।

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৬
Share: Save:

অগণিত সাধারণ মানুষ যাহা চাহিয়াও বলিতে পারেন নাই, এবং রাজনৈতিক প্রভুরা ভুলিয়াও যে কথাটি বলিতে চাহেন নাই, মাদ্রাজ হাইকোর্টে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি সেন্থিলকুমার রামমূর্তির বেঞ্চ সেই কথাটিই বলিল— দেশে (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় ভোটের রাজ্যে) কোভিড-এর দ্বিতীয় প্রবাহের এই ভয়াবহ রূপের জন্য দায়ী নির্বাচন কমিশন। আদালতের পর্যবেক্ষণে কিছু কিছু ভাষাভঙ্গি কতটা বাঞ্ছনীয়, নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদের বিরুদ্ধে স্বপ্রবৃত্ত হইয়া খুনের মামলা দায়ের করিবার এক্তিয়ার আদালতের আছে কি না, ভোটগণনা স্থগিত করিয়া দিলেই সমস্যার সমাধান হইবে কি না, এই সব প্রশ্ন উঠিতেছে বটে— কিন্তু, তাহাতে তিরস্কারের মূল সুরটি ঢাকা পড়ে না। মানুষের জীবন অপেক্ষা আর কিছুই যে অধিক মূল্যবান নহে, সেই কথাটি স্মরণ করাইয়া বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, মানুষ প্রাণে বাঁচিলে তবে তো ভোট দিবার গণতান্ত্রিক অধিকারের মূল্য। কথাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। যে পাঁচ রাজ্যে ভোট হইল, তাহার একটিতেও এমন অবস্থা ছিল না যে, এই মুহূর্তে ভোট না হইলে জনজীবন বিপর্যস্ত হইবে। যেখানে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাহার হাতেই প্রশাসনিক দায়িত্বনির্বাহের অধিকার ছাড়িয়া রাখা যাইত। ইহাতে বিজেপির আপত্তি থাকিতে পারে— পশ্চিমবঙ্গের মসনদ দখলে তাহাদের অত্যুৎসাহ দৃষ্টিকটু রকম প্রকট— কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের সেই আপত্তি থাকিবার কথা নহে। তাহা হইলে সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি লইয়াও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল কেন? এই প্রশ্নটির সদুত্তর না দিতে পারিলে কোভিডে এই বিপুল প্রাণহানির নৈতিক দায়িত্ব কমিশন অস্বীকার করিতে পারে কি?

কেহ বলিতে পারেন, নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশের সময় কোভিড পরিস্থিতি এতখানি ভয়াবহ ছিল না। তাহা সত্য। কিন্তু, নির্বাচন উপলক্ষে যে মিটিং-মিছিল হইবে, বাহির হইতে কেন্দ্রীয় বাহিনী আসিবে, বিপুল সংখ্যক কর্মীকে ভোটের কাজে নামিতে হইবে, এবং সব মিলাইয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা ঊর্ধ্বমুখী হইবে, কমিশন কি তাহা জানিত না? ইহাও কি জানিত না, ভোটকর্মীদের কোভিড-নিরাপত্তার ব্যবস্থা শেষাবধি তাহারা করিয়া উঠিতে পারিবে না? না জানিলেও, সংক্রমণ অতি দ্রুত বাড়িতে দেখিয়াও ভোটগ্রহণের পর্বসংখ্যা কমাইবার সিদ্ধান্ত কমিশন ঘোষণা করিল না কেন, যে সংখ্যা এমনিতেও অস্বাভাবিক বেশি? এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন দফার সংখ্যা কমাইয়া আনিবার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিলেন, কমিশন তাহাতেও কর্ণপাত করিল না! কেন? কেনই বা প্রধানমন্ত্রী নিজের সফর বাতিল করিবার পূর্ব অবধি কমিশন নির্বাচনী সভায় নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে পারিল না? নির্বাচন কমিশনকে দেখিয়া বারে বারেই মনে হইয়াছে, শাসকদের খাঁচায় একমাত্র তোতা সিবিআই নহে, আরও অনেকেই স্বেচ্ছায় সেই দাঁড়ে বসিয়াছে।

নির্বাচন কমিশনকে ‘একমাত্র দোষী’ সাব্যস্ত করিলে কি রাজনৈতিক দলগুলিকে, তাহাদের নেতৃত্বকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয় না? কেন্দ্রীয় সরকারকেও কি অপদার্থতার অভিযোগ হইতে অব্যাহতি দেওয়া হয় না? প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ। তবে দুইটি কথা স্মরণে রাখা আবশ্যক। এক, নির্বাচন কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা, যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার তাহাদের আছে; এবং দুই, গত সাত বৎসরে কেন্দ্রীয় সরকার, এবং তাহার প্রধান নেতৃত্বের দায়িত্বজ্ঞানের বহর লইয়া তিলমাত্র সংশয় নাই। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের আরও সাবধান হইবার প্রয়োজন ছিল। সরকার যেখানে জনস্বার্থের কথা ভাবিতে অভ্যস্ত নহে, সেখানে স্বশাসিত সংস্থাগুলির দায়িত্ব বাড়ে। সেই দায়িত্বের কথা সংবিধানের অক্ষরে লিখিত নহে, মানুষের প্রতি কর্তব্যের ধর্মে নিহিত। কমিশন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। আদালতের তিরস্কার তাহার প্রাপ্য। কিন্তু, তিরস্কৃত হইলেই কি প্রায়শ্চিত্ত সম্পন্ন হইবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madras High Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE