অকস্মাৎ এক ঝলক তাজা নিঃশ্বাস ফিরে পেল এই অসুস্থ, দূষিত পৃথিবী। জলপথে গাজ়াবাসীদের প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনোর জন্য ফ্লোটিলা জাহাজের ছবি সেই তাজা হাওয়ার ঝলক: সমগ্র বিশ্ব দেখল, ‘মানবিকতা’ নামে মূল্যবোধটি আজ পরাজিত, প্রত্যাখ্যাত হয়েও শূন্যে বিলীন হয়ে যায়নি। সেপ্টেম্বরে পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ-সহ পাঁচশোর বেশি রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মীকে নিয়ে গাজ়ার জন্য ত্রাণসামগ্রী বহন করে ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ (জিএসএফ) নামক ৪৫টি জলযান রওনা হয় স্পেন থেকে। লক্ষ্য— অহিংস পথে গাজ়ায় ইজ়রায়েলের সামরিক অবরোধ ভেঙে সমুদ্রপথে ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি মানবিক জলপথ তৈরি করা। একই সঙ্গে ওই ভূখণ্ডে প্রায় দু’দশক ধরে মানুষের দুর্দশার প্রতি আরও বেশি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলেন তাঁরা। আশঙ্কা ছিলই যে তাঁদের সবলে বাধা দেওয়া হবে। আশঙ্কা বর্ণে বর্ণে সত্য হল। গাজ়ার উপকূলে পৌঁছনোর অনেক আগেই তাঁদের আটকে দিল ইজ়রায়েলি নৌবাহিনী। গ্রেটা-সহ বহু আন্দোলনকারীকে কারাগারে আটক করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে জানা গেল। যদিও ইজ়রায়েল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, নৌবহরগুলি একাধিক সতর্কতা উপেক্ষা করে আইন লঙ্ঘনের চেষ্টা করছিল। তাঁদের মতে, এই অভিযান নাকি মানবিক সাহায্যের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক উস্কানি। তবে, যে ভাবে এই মানুষগুলিকে বিনা প্ররোচনায় বন্দি করা হল তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট। বিরোধীরা যে যেমনই হোন না কেন, ইজ়রায়েলের লক্ষ্য— গাজ়াবাসীদের শুধু প্রাণেই নয়, ত্রাণেও মারতে হবে। সন্দেহ নেই, এই রকম ভাবনা ও কর্মপদ্ধতির একটি বিশ্বস্বীকৃত নাম আছে: জেনোসাইড।
এই ঘটনা আরও একটি বিষয় প্রমাণ করল। ইজ়রায়েল এখন সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক জলসীমায় এক নির্দিষ্ট পরিধির বাইরে কোনও নৌবহরকে বাধা দেওয়া যায় না। ‘ইউএন কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি’ (ইউএনসিএলওএস)-র অন্তর্গত যে কোনও রাষ্ট্র তাদের উপকূল থেকে মাত্র ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে বাধা বা অবরোধ কার্যকর করার অনুমতি দেয়। অথচ, এ ক্ষেত্রে জানা গিয়েছে, জাহাজগুলিকে গাজ়ার উপকূল থেকে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ নটিক্যাল মাইল দূরেই আটক করা হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। লক্ষণীয়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার পরে গাজ়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে পণ্য প্রবেশের উপরে ইজ়রায়েল-এর নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ কঠোর হয়েছে— সেখানেও আন্তর্জাতিক ধারা অমান্য হয়েছে পদে পদে। অগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, দুই বছরের ইজ়রায়েলি অস্ত্রবর্ষণ গাজ়াকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘মানবসৃষ্ট’ দুর্ভিক্ষ ও তীব্র জীবনসঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
তবে এই সমুদ্র অভিযানের ত্রাণ প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও অন্য একটি লক্ষ্য অনেকাংশে সফল। গ্রেটা-সহ বিভিন্ন দেশের ১৭০ জন আন্দোলনকারীকে ইজ়রায়েল আপাতত মুক্তি দিয়েছে, এবং স্বদেশে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার পর ইজ়রায়েল নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বহমান— বহুবিলম্বিত এই ঝড়; হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প। তবু, আশা করা যায়, ইজ়রায়েলের উপর কিছু আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ফিরিয়ে আনার কথা ভাবা হবে। নতুন বিধিনিষেধ বা সহযোগিতা চুক্তি স্থগিত রাখা নিয়ে পশ্চিমি শক্তিগুলি মাথা ঘামাবে, ইউরোপে যে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে সংবাদ। তা ছাড়া, গ্রেটা থুনবার্গের বক্তব্যে আমেরিকার ভূমিকা নিয়েও পরোক্ষ সমালোচনা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। গাজ়ার পরিস্থিতি এখন আর কোনও রাজনৈতিক বিষয় নয়, মানবাধিকার হরণ-পীড়ন ও জেনোসাইডের প্রশ্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)