E-Paper

চক্ষুলজ্জা কোথায়

সুতরাং অঙ্কের ধাপ অনুযায়ী, কার্নিভাল মেটার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে নেত্রী পৌঁছে গিয়েছেন উত্তরবঙ্গে, যত্রতত্র নেমে পড়েছেন গাড়ি থামিয়ে।

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:১২
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

রাজ্যের এক প্রান্ত যখন বিধ্বস্ত, অন্য প্রান্তে তখন কার্নিভাল চলছে, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তাতে মেতে উঠেছেন। কেউ বলতেই পারেন, এত বড় রাজ্যে, বা আরও বড় এই দেশে, অথবা সমগ্র বিশ্বে যত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে চলেছে, সর্ব ক্ষণ যদি সে-সব কথা মাথায় রাখতে হয়, তা হলে কি সত্যিই আর কোনও আনন্দ করা সম্ভব? জগতের ধর্মই তো এই— সুখ দুঃখ কেবল চক্রবৎ ঘোরে না, নিতান্ত পাশাপাশি অবস্থান করে। তবে, জগতের ধর্ম ও প্রশাসকের ধর্ম এক হবেই, এমন কোনও কথা নেই। ঠিক যে মুহূর্তে রাজ্যের এক প্রান্ত ভেসে যাচ্ছে ভয়াল বন্যায়, মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই, সেই সময়টিতেই উৎসবে মেতে ওঠা আমজগতে চলতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রশাসক তা করলে তাকে কোনও দার্শনিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এমন ঘটনা এই প্রথমও নয়। পুজোর আগে যে দিন অভূতপূর্ব বর্ষণে কলকাতা ডুবে গেল, বেশ কয়েকজন মানুষ প্রাণ হারালেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, তার পরে পরেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের লেখা, সুর দেওয়া গান প্রকাশ করেছিলেন সমাজমাধ্যমে। গত বছর যখন আর জি করের নিহত ছাত্রীর প্রতি সমবেদনায় শহর উত্তাল, তখনও তাঁকে দেখা গিয়েছিল কার্নিভালে। কেউ ভাবতে পারেন, ‘আনন্দ হি কেবলম্‌’ কথাটিকে মুখ্যমন্ত্রী হয়তো বড়ই আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। আবার কেউ অনুমান করতে পারেন, এ কোনও সামান্য শারদ সমাপতন নয়, এই কার্নিভাল যাপন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য অতি গুরুত্বময়, এর মধ্যে বস্তুত নিহিত আছে এক অদৃশ্য শাসনকৌশল। গত চোদ্দো বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, উৎসব তাঁর শাসনকৌশলের কত বড় সম্পদ। রাজ্যের বিবিধ প্রান্তে সম্বৎসর বিবিধ উৎসব ও মেলার মাধ্যমে একটি বিনোদন সংস্কৃতি জাগরূক রাখা পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনোবিজয়ের জন্য কত কার্যকর। ফলত যাঁরা ভাবছেন, কার্নিভালে অংশগ্রহণ করে মুখ্যমন্ত্রী ভুল করলেন, হয়তো তাঁরা তাঁর রাজনীতির অভিমুখটি এখনও সম্পূর্ণ বোঝেননি। তাঁর প্রশাসনিক পরিকল্পনার মধ্যে যে কোনও উৎসবের গুরুত্বই শীর্ষস্থানীয়, শারদ কার্নিভালের তো কথাই নেই।

সুতরাং অঙ্কের ধাপ অনুযায়ী, কার্নিভাল মেটার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে নেত্রী পৌঁছে গিয়েছেন উত্তরবঙ্গে, যত্রতত্র নেমে পড়েছেন গাড়ি থামিয়ে। শোনা গিয়েছে, রেড রোডের আনন্দঘন মুহূর্তেও তিনি বারে বারেই খোঁজ নিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, মুখ্যমন্ত্রী কার্নিভালে যোগ না দিয়ে যদি সে রাতেই উত্তরবঙ্গে ছুটতেন, অথবা নবান্নের কন্ট্রোল রুমে বসে থাকতেন, বন্যা পরিস্থিতি পাল্টাত কি? না। যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে একা হাতে সামাল দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। তবুও তিনি যে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, তার একটি অংশ বিপর্যস্ত হলে তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ সেই পরিস্থিতির দিকেই থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। এমনটাই কর্তব্য। তবে অধুনা যে কোনও দুর্যোগই রাজনীতির হিসাব কষার মাহেন্দ্রসুযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও, দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। সে কথা আবারও প্রমাণিত হল। বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে দিয়ে বিজেপির সাংসদ-বিধায়কের প্রহৃত হওয়ার ঘটনা চরম নিন্দনীয়, রাজনৈতিক রং বিচার না করেই দোষীদের গ্রেফতার করা জরুরি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এই সুযোগে ক্ষুদ্র রাজনীতিতে উদ্বেলিত হলেন। ও-দিকে মুখ্যমন্ত্রী উৎসব-অঙ্ক মিটিয়ে আসরে নেমে বন্যার দায় চাপালেন সিকিম-ভুটানের উপরে। উল্লেখ করলেন না দেশের অন্যান্য অংশের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও পাহাড়ে অবাঞ্ছিত, অবিবেচনাপ্রসূত নির্মাণের কথা, যেমন খুশি গাছ কাটার কথা, নদীর পাথর চুরি করার কথা। বললেন না যে, ডুয়ার্স-এ নদীগুলি নাব্যতা হারিয়েছে মূলত অসৎ রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে। নিজস্ব প্রশাসনের, দলের অন্যায়গুলিকে আড়াল করে রাখার নামই রাজনীতি। এবং রাজনীতির অন্যায়গুলিকে আড়াল করে রাখার জন্যই দরকার, আরও উৎসব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mamata Banerjee Durga Puja Carnival

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy