E-Paper

অচল শিক্ষা

৫৩,৭৪৯টি পিয়নের পদের জন্য ২৪.৭৬ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে। ন্যূনতম যোগ্যতা চাই দশম শ্রেণি পাশ, অথচ প্রার্থীদের অনেকেই এমবিএ, পিএইচ ডি, আইনের ডিগ্রিধারী।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৫ ০৬:৩৪

সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, তবে চাকরি করছেন জীবনবিমা সংস্থায়। কিংবা, বাণিজ্য শাখার স্নাতক, ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর, একটি গুদামে হিসাবরক্ষকের কাজ করছেন। যে বিষয়ে পড়েছেন বা যে ওজনের ডিগ্রি, জীবিকার প্রকৃতি তার সঙ্গে মেলে না— এমন বহু মানুষ চার পাশে। এই প্রবণতা কতটা বেড়েছে তা গত মাসের একটি সমীক্ষাতেই স্পষ্ট, দেশে মাত্র ৮.২৫% স্নাতকের পেশা তাঁদের ডিগ্রির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সমস্যাকে আরও নজরে আনল রাজস্থানের খবর। ৫৩,৭৪৯টি পিয়নের পদের জন্য ২৪.৭৬ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে। ন্যূনতম যোগ্যতা চাই দশম শ্রেণি পাশ, অথচ প্রার্থীদের অনেকেই এমবিএ, পিএইচ ডি, আইনের ডিগ্রিধারী। স্নাতকোত্তরের পর যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁরাও আবেদন করেছেন। অর্থাৎ, চাকরির বাজারে এঁদের উচ্চশিক্ষার দাম নেই। এমন উদ্বেগজনক খবর মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে। অকুস্থল কখনও রাজস্থান, কখনও বিহার অথবা মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ। এই পরিস্থিতির শিকড় কোথায়? নিয়োগে অস্বচ্ছতা? চাকরির অভাব? ভুল শিক্ষাব্যবস্থা?

এত উচ্চশিক্ষিত বেকার থাকার অর্থ দেশে চাকরি তৈরি হচ্ছে না; এবং, যে চাকরিগুলি তৈরি হচ্ছে, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে ছাত্ররা সেই চাকরির উপযুক্ত কর্মী হয়ে বেরোচ্ছেন না। কথাটির দু’টি অংশই তাৎপর্যপূর্ণ। গত এক দশকে অর্থব্যবস্থার বিপুল ক্ষতি হয়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়েছে। পণ্যের বাজারে যথেষ্ট চাহিদা নেই। অতএব, উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদও নেই, ফলে শ্রমেরও চাহিদা নেই। সরকারি চাকরিই একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণীর কাছে। সে চাকরি যদি পিয়ন পদেও হয়, তা-ও সই। অন্য দিকে, চাকরির জন্য প্রকৃত যে যোগ্যতা প্রয়োজন, অধিকাংশ প্রার্থীরই তা নেই। রাজস্থানে যত উচ্চশিক্ষিত প্রার্থী পিয়নের চাকরির জন্য আবেদন করেছেন, কাজের বাজারে তাঁদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার একটি কারণ কিন্তু এই প্রকৃত যোগ্যতার অভাব। চাকরির বাজার বিবর্তিত হচ্ছে। নিয়োগযোগ্যতা বাড়াতে প্রযুক্তিগত বিদ্যা, সফ্‌ট স্কিল, বাস্তবমুখী জ্ঞান পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি ব্যবসায়ী হওয়ার কর্মশালা, বিনিয়োগের পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পমহল যা চায়, শিক্ষাব্যবস্থায় তার প্রতিফলন না ঘটলে এই সঙ্কট ঘুচবে না।

দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের জগদ্দল মানসিকতাও বড় কারণ। স্কুলছুট না হয়ে যাঁরা দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ হন, তাঁদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষার পথে হাঁটেন। তার একটি বড় কারণ, এ দেশে দশম-দ্বাদশ শ্রেণির পর বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণের চল নামমাত্র— এবং, সেই পেশার সামাজিক সম্মান নামমাত্রও নয়। সামাজিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিসাবে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বাসনাটি ভারতীয় সমাজের এমনই গভীরে প্রোথিত যে, তা অন্য পথগুলির সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করে দেয়। অতএব, শ্রমজীবী হয়েও সম্মানজনক জীবনযাপনের উপায় ভারতে নেই। দুর্ভাগ্য যে, বহু মানুষই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরে এমন কাজ করেন, অথবা করতে বাধ্য হন, যার জন্য সেই শিক্ষাগত যোগ্যতার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। উচ্চশিক্ষা নামক অতি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক সম্পদের বণ্টনে এই গোলমাল দূর করার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Unemployment Job Vacancy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy