E-Paper

আনন্দের আতঙ্ক

প্রতি বছর দুর্গাপুজো উপলক্ষে রাস্তার যে ক্ষতি পুজো কমিটিগুলি করে, পূর্ত বিভাগ অথবা পুরসভা থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় কি? না কি, দুর্ভোগ যেমন জনতার, রাস্তার ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগানের দায়ও তাদেরই?

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৯

পঞ্জিকার হিসাবে আজ মহাসপ্তমী বটে, কিন্তু বাঙালির পুজো-উৎসব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে অন্তত সপ্তাহখানেক আগেই। এখন মহালয়া থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে লাইন পড়ে। এবং, পুজোর দুর্ভোগের মেয়াদও তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বেড়েছে। এ বছর শহরের এক পুজোর প্রস্তুতিপর্বে নাজেহাল এক নাগরিক থানাপুলিশ করেছিলেন, তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে প্যান্ডেল করা নিয়ে। আরও কত লক্ষ নাগরিক প্রতি বারই এমন নালিশ ঠোকার কথা ভাবেন, এবং শেষ অবধি পিছিয়ে আসেন, সে সংখ্যাটি শহরবাসীমাত্রেই অনুমান করতে পারেন। বারোয়ারি দুর্গাপুজো মানে যে কিছু মানুষের আনন্দের পাশাপাশি আরও অনেক মানুষের প্রভূত ভোগান্তির কারণ, কলকাতা নাগরিকদের সে কথা হাড়ে হাড়ে শিখিয়ে ছেড়েছে। প্যান্ডেলের পাশাপাশি রয়েছে অন্তহীন স্টল— যে পুজো যত বড়, তাকে ঘিরে স্টলের সংখ্যাও তত বেশি। খাবারের স্টল মানেই বিস্তর আবর্জনা— বিক্রেতার তরফেও, ক্রেতার তরফেও। স্থানীয় বাসিন্দাদের সয়ে নিতে হয় সে ভোগান্তিও। বাড়িতে ঢোকা-বেরোনোও রীতিমতো অভিযান— কারণ, তার সামনে বাঁশের দীর্ঘ বেড়া, প্যান্ডেলে ঢোকার লাইন যাবে সেখান দিয়ে। এ বছর কিছু কিছু প্যান্ডেল আরও এক কাঠি বাড়া— বাঁশ পরিত্যাগ করে এ বার একেবারে লোহার কাঠামো তৈরি করা হয়েছে প্যান্ডেলে ঢোকার লাইনের; রাস্তায় গর্ত করে তা সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর দুর্গাপুজো উপলক্ষে রাস্তার যে ক্ষতি পুজো কমিটিগুলি করে, পূর্ত বিভাগ অথবা পুরসভা থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় কি? না কি, দুর্ভোগ যেমন জনতার, রাস্তার ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগানের দায়ও তাদেরই?

অত্যাচারের এই প্রাবল্যে অনেকের কাছে দুর্গাপুজোর সময়টি নির্ভেজাল আতঙ্কের ঋতু হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন হল, তাঁদের এই সমস্যাকে কী ভাবে দেখা বিধেয়? সংখ্যাগরিষ্ঠের আনন্দের কাছে তুলনায় কম সংখ্যক মানুষের ভোগান্তি কি সহ্য করে নেওয়াই বিধেয়— সমাজের সর্বমোট উপভোগের মাত্রা সর্বোচ্চ সম্ভাব্য স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য? না কি, এ ক্ষেত্রে নীতিটি হওয়া উচিত এই রকম যে, যত জনেরই ফুর্তি হোক, তার জন্য এক জনের নাগরিক অধিকারকেও সঙ্কুচিত করা চলতে পারে না? এই প্রশ্নের উত্তর রাজ্য প্রশাসনকেই খুঁজতে হবে। প্রশাসনের কাছে যদি নাগরিকের সুস্থ জীবনযাপনের অধিকারটি অনস্বীকার্য হয়, তবে রাস্তা বন্ধ করা, অথবা পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করার অভিযোগ উঠবে যে সর্বজনীন পুজোর বিরুদ্ধে, তার প্রতি কঠোর হতে হবে অবিলম্বে। প্রয়োজনে পরের বছর পুজোর অনুমতি প্রত্যাহার করা যেতে পারে। রাজ্য সরকার পুজোর যে অনুদান দেয়, নাগরিকের অস্বাচ্ছন্দ্য না ঘটানো তার অন্যতম শর্ত হতে পারে। ভাবতে হবে সমাজকেও। বারোয়ারি পুজো আজ আর সামান্য কোনও বিষয় নয়— বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থায় দুর্গাপুজোর গুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পুজোর পুরস্কারের সংখ্যাও বাড়ছে তালে তাল মিলিয়ে। পুরস্কারদাতা সংস্থাগুলি যদি শুধু প্যান্ডেল, প্রতিমা বা আলোকসজ্জা নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগের কথাও বিবেচনা করে, তা হলে পুজো কমিটিগুলি সচেতন হবে। অন্য দিকে, যাঁরা আনন্দ করতে বেরোন, তাঁদেরও সংযত হওয়া বিধেয়। উৎসব মানে যে নাগরিক বোধ সম্পূর্ণ বিসর্জন দেওয়া নয়, এই কথাটি বোঝা কতখানি কঠিন?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Road condition Durga Puja 2025 Road safety

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy