E-Paper

জোট-(অ)ধর্ম

শোরগোলের উত্তরও আসতে শুরু করেছে। মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, শরিকি বাধ্যবাধকতা অন্তত কংগ্রেস ভাল করেই জানে— দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে এই কারণেই ‘রোলব্যাক সরকার’ দুর্নাম কুড়াতে হয়েছিল।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৪ ০৭:৫৫

আপন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ নিয়ে কাউকে কুকথা বলা মুশকিল, বিশেষত আজকাল যখন যে কোনও নিরাপত্তা নির্দেশিকার প্রথমেই বলা থাকে, আগে নিজের প্রাণটি বাঁচিয়ে তবেই অন্যের মুখে অক্সিজেন প্রদান করা দরকার। তবে কিনা, এ সবের পরও একটা কথা থাকে। শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণটি বাঁচানোই যদি এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, এবং তার বাইরে যদি ব্যক্ত ও ব্যাপ্ত হয় অপরের বিষয়ে ঔদাসীন্য— তা হলে কুকথাকে ঠিক অকারণ বলা যায় না। বাজেট নিয়ে বিরোধীরা যে সব নিন্দামন্দের ঝড় তুলেছেন, তা দেখেশুনে এ কথাই মনে হয়। নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে নির্মলা সীতারামন অর্থমন্ত্রী হিসাবে এ-যাবৎ ষষ্ঠ বার পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন। কিন্তু এ বারের বিশেষত্বটি নজর এড়ানোর মতো নয়। বিদেশি সংবাদমাধ্যমও ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছে যে ভারতের বর্তমান সরকার এত বিপজ্জনক ভাবে নির্ভরশীল অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, এই দুই শরিকের উপর— সেই বাধ্যবাধকতার বিরাট ছাপ এ বারের বাজেটে। পরিকাঠামো লগ্নির লক্ষ্যে বিহারে ছাব্বিশ হাজার কোটি, অন্ধ্রে পনেরো হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর হল, যেখানে অন্য রাজ্যের ঝুলিতে নিতান্ত নগণ্য প্রাপ্তি। স্বভাবতই বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তীব্র সমালোচনায়। এমন একটি ‘কুর্সি বাঁচাও বাজেট’ দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক, শোরগোল তুলেছে বিরোধী ইন্ডিয়া মঞ্চ।

শোরগোলের উত্তরও আসতে শুরু করেছে। মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, শরিকি বাধ্যবাধকতা অন্তত কংগ্রেস ভাল করেই জানে— দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে এই কারণেই ‘রোলব্যাক সরকার’ দুর্নাম কুড়াতে হয়েছিল। ডিএমকে বা সিপিআই(এম)-এর চাপে কংগ্রেসকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এফডিআই-এর ভাবনা থেকে সরে আসতে হয়েছিল, বাজেটেও যার ছাপ পড়েছিল। বাস্তবিক, জোটের বাস্তব যে কঠিন, এমনকি বিপজ্জনক, ভারতীয় গণতন্ত্রের যাত্রাপথ তা বারংবার প্রমাণ করে দিয়েছে। শাসক দল, কিংবা মন্ত্রকের দায়িত্বে যে দল, সেই দল যে যে রাজ্যের দায়িত্বে, তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ বারংবার উঠেছে। ফলে বর্তমানের তৃতীয় এনডিএ সরকারের দিকে আলাদা করে আঙুল তোলা অর্থহীন। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। প্রাপ্তি ও বঞ্চনার অনুপাতটি যদি এত ভয়ানক দৃষ্টিকটু হয়, তাকে কেবল স্বাভাবিক সঙ্কট বলে ব্যাখ্যা করা চলে না। এর মধ্যে বিরোধীদের প্রতি অন্যায় নিহিত আছে। আছে বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিকে প্রায় ‘শাস্তি’ দেওয়ার প্রয়াস। জোটধর্ম অনপনেয় হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের ধর্মটিও তো ফেলনা নয়।

গত দশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, নরেন্দ্র মোদী সরকারের মূল সমস্যাটি অহম্-এর। প্রধান নেতা থেকে শুরু করে সরকারের অন্যান্য মুখ্যচরিত্র, সকলেরই সমস্যা এই যে গণতন্ত্রের অনুশীলনে তাঁদের অসীম অনীহা। বিরোধী পক্ষ যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ, এ কথা তাঁরা অস্বীকার করে নিজেদের দিকটিকেই একমাত্র বাস্তব বলে মনে করেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির সাংসদ-সংখ্যার রকম দেখে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, এ বারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকারের সেই আগেকার দর্প কিঞ্চিৎ প্রশমিত হবে। কিন্তু নানা ইঙ্গিত বলছে, সে আশা ভিত্তিহীন। এবং সঙ্গী শরিক দলগুলি যে-হেতু নিজেদের আখের যথাসম্ভব ও যথাসত্বর গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত, তাদের কাছে ভিন্ন ব্যবহার আশা করাই অসম্ভব। এ বারের বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের সামূহিক অপ্রাপ্তি নিশ্চয় রাজ্যবাসীর কাছে একটি দুঃসংবাদ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়িত্ব, সেই বার্তা যথাযোগ্য জায়গায় পেশ করা ও রাজ্যের বঞ্চনার সুরাহা করা। তবে, যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক আদর্শের এই ধারাবাহিক অবমাননা হয়তো আরও বড় মাপের দুর্ভাগ্যময় বাস্তব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Union Budget 2024 PM Narendra Modi Nirmala Sitharaman Opposition

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy