Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Graham Staines Murder

দুরপনেয়

জাতীয় বা স্থানীয় স্তরে কোনও তদন্তে কখনও জোর করে ধর্মান্তরণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। সংখ্যালঘুদের উপর হিংসায় পুলিশ হয় নিষ্ক্রিয় থেকেছে, নয় পরোক্ষে মদত দিয়েছে।

ছবি: সমাজমাধ্যম।

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৮
Share: Save:

সমগ্র দেশের সংবাদ যখন নিবিষ্ট অযোধ্যার সমারোহে, তখন ওড়িশার কেওনঝড়ের মোহনপুরের মানুষ গ্রাহাম স্টেনস ও তাঁর দুই সন্তানের পঁচিশতম মৃত্যুদিবস উদ্‌যাপন করলেন। ১৯৯৯-এর ২২ জানুয়ারির সেই ঘটনা আধুনিক ভারতের ইতিহাসে দুরপনেয় কলঙ্ক। অস্ট্রেলীয় মিশনারি স্টেনস ও তাঁর দুই বালক পুত্রকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। মোহনপুরের এক শিবিরে যোগ দেওয়ার পর রাতে তাঁরা গাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন, বজরং দলের কিছু সমর্থক গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মূল অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, কিন্তু তাতে কতটুকু সান্ত্বনা মিলতে পারে? বিশেষত যেখানে খ্রিস্টান মিশনারি সংগঠনগুলিকে ক্রমাগত কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া পুরোদমে চালু রয়েছে, খ্রিস্টানদের উপরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আক্রমণ আরও বেড়েছে। গত বছর মণিপুরে গির্জা পোড়ানোর ধুম, খ্রিস্টান জনজাতিদের উপর মেইতেই হিংসার তীব্রতা সারা দেশকে স্তম্ভিত করেছে। ‘ইভানজেলিক্যাল ফেলোশিপ অব ইন্ডিয়া’-র তথ্য অনুসারে, ২০১২ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ভারতে খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ চার গুণ বেড়েছে। ২০২২-এ তা ছিল সর্বোচ্চ— প্রায় ছ’শোটি ঘটনা ঘটেছিল। এর অধিকাংশের পিছনেই ছিল এমন সন্দেহ যে, খ্রিস্টানরা ধর্মান্তরণ করছে। গ্রাহাম স্টেনসের বিরুদ্ধেও সেই অভিযোগই ওস্কানো হয়েছিল। যদিও ওড়িশার বারিপদায় তিনি ছিলেন সুপরিচিত ও জনপ্রিয়, যৌবন থেকে কুষ্ঠরোগীদের সেবায় নিয়োজিত। স্টেনস-হত্যা সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হিংসার অভিযোগ ওঠে।

কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকার স্টেনস-হত্যাকে বিচ্ছিন্ন দুষ্কৃতীদের কাজ বলে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী নানা সংগঠনের কার্যক্রমের উপরে সঙ্ঘ-সম্পৃক্তদের যে হিংসা নেমে এসেছে, তার নকশাটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালে ওড়িশারই কন্ধমল জেলায় ‘কুই’ভাষী খ্রিস্টানরা তফসিলি জনজাতির পরিচিতি পাওয়ার দাবি তোলেন। তার জেরে হিন্দুদের সঙ্গে সংঘাতে একশোরও বেশি খ্রিস্টান নিহত হন, বহু গির্জা ও বসতবাড়ি পোড়ানো হয়। সে বারও অভিযুক্ত হয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল। এর পর থেকেই গড়ে ওঠে প্রান্তিক এলাকায় কর্মরত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলিকে ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতি। ছোট-বড় হিংসার নানা ধারাবাহিক ঘটনায় এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয়, যেখানে অহিন্দু ধর্মীয় বা সামাজিক সংগঠনের উপর সহজেই ধর্মান্তরণের আরোপ আনা চলে, এবং তার প্রতিরোধ করতে হিংসার ব্যবহার ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে।

অথচ, জাতীয় বা স্থানীয় স্তরে কোনও তদন্তে কখনও জোর করে ধর্মান্তরণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। সংখ্যালঘুদের উপর হিংসায় পুলিশ হয় নিষ্ক্রিয় থেকেছে, নয় পরোক্ষে মদত দিয়েছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক বঞ্চনা— অনেক খ্রিস্টান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিদেশি অনুদান গ্রহণের লাইসেন্স (এফসিআরএ) বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ, অহিন্দুদের প্রতি বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক আকার নিচ্ছে। সান্ত্বনা যদি কিছু থাকে, তা মিলতে পারে গ্রাহাম-পত্নী গ্ল্যাডিস স্টেনস-এর কাজে। তিনি আজও কুষ্ঠরোগীদের জন্য হাসপাতাল চালাচ্ছেন বারিপদায়। বহু ব্যয়ে নির্মিত দেবালয়ের আলোকসজ্জায় নয়, মানবধর্মের মঙ্গলালোকে আলোকিত পথটি যাচ্ছে ওই নির্ভয়, প্রেমপূর্ণ সেবার সদনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE