অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ‘প্রতীচী’ আবাস নিয়ে যা ঘটে চলেছে, তা এই অবিশ্বাস্য কদর্যতার এক উৎকট রূপ। ফাইল চিত্র।
একশো চার বছর আগে, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৮ আষাঢ় শান্তিনিকেতনে ‘আশ্রমের অধিপতি শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সভাপতিত্বে প্রারম্ভোৎসব সমাধা করিয়া’ বিশ্বভারতীর কাজ শুরু হয়। সেই উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতার সূচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বর্তমান কালে আমাদের দেশের উপরে যে শক্তি, যে শাসন, যে ইচ্ছা কাজ করছে, সমস্তই বাইরের দিক থেকে। সে এত প্রবল যে তাকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে আমরা কোনো ভাবনাও ভাবতে পারি নে। এতে করে আমাদের মনের মনীষা প্রতিদিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা অন্যের ইচ্ছাকে বহন করি, অন্যের শিক্ষাকে গ্রহণ করি, অন্যের বাণীকে আবৃত্তি করি, তাতে করে প্রকৃতিস্থ হতে আমাদের বাধা দেয়।” অতঃপর তাঁর ক্ষুব্ধ তিরস্কার বর্ষিত হয়েছিল চাটুকারবৃত্তি বা চরবৃত্তিতে দীক্ষিত সেই গোত্রের লোকদের প্রতি, যারা ‘রাষ্ট্রীয় আবর্জনাকুণ্ডের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়’। ক্ষোভে ও বেদনায় আর্ত এই প্রথম অনুচ্ছেদটি শেষ হয় এক গভীর উদ্বেগের সুরে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “এমন অবস্থায় বড়ো করে দৃষ্টি করা বা বড়ো করে সৃষ্টি করা সম্ভবপর হয় না; মানুষ অন্তরে বাহিরে অত্যন্ত ছোটো হয়ে যায়, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়।”
বিদেশি শাসনের বশীভূত সমাজের এই ক্ষুদ্রতাকে মেনে না নিয়ে বৃহত্ত্বের সাধনায় আত্মশক্তির জাগরণ, অনুশীলন ও উন্নতিসাধনের লক্ষ্যেই সে দিন বিশ্বভারতীর নতুন পর্বের সূচনা হয়েছিল। সেই অভিযান এখন সর্ব অর্থেই অতীত। নানা দিক থেকে বিশ্বভারতীর ক্রমাবনতির ইতিহাস আজকের নয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে তার যে ভয়াবহ পরিণতি উত্তরোত্তর প্রকট হয়েছে, সেটা আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব, একই সঙ্গে অকল্পনীয়ও বটে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ‘প্রতীচী’ আবাস নিয়ে যা ঘটে চলেছে, তা এই অবিশ্বাস্য কদর্যতার এক উৎকট রূপ। তেরো ডেসিম্যাল জমির মালিকানা নিয়ে বিশ্বভারতীর মতো একটি প্রতিষ্ঠান এমন আচরণ করার কথা ভাবতে পারে, এটুকুই যে কোনও সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের বিবমিষা উদ্রেক করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা সে-কথা কেবল ভাবেননি, সেই ভাবনাকে কাজে পরিণত করেছেন এবং ক্রমাগত করে চলেছেন। আইন-আদালতের কাজ সেই পরিসরেই হোক, কিন্তু বড় প্রশ্নটা আইন-আদালতের নয়, সভ্যতার— যে সভ্যতার সমস্ত স্বাভাবিক রীতিনীতি ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। মানুষ এবং প্রতিষ্ঠান অন্তরে অন্দরে কতটা ছোট হয়ে গেলে এমন আবর্জনার সৃষ্টি হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।
প্রবীণ এবং বিশ্ববন্দিত শিক্ষাব্রতীর বিরুদ্ধে এই আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণটি কী, সে বিষয়ে সংশয়ের কিছুমাত্র অবকাশ আছে কি? রবীন্দ্রনাথ যে ‘চাটুকারবৃত্তি’ এবং ‘চরবৃত্তি’র কথা বলেছিলেন, সমস্ত ঘটনাবলিতে তার পরিচয় সুস্পষ্ট। অমর্ত্য সেনের প্রকৃত অপরাধ একটিই: তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্তমান যন্ত্রীদের অন্যায় এবং অনাচারের কঠোর ও স্পষ্টবাক সমালোচনায় অক্লান্ত। অতএব, সমালোচনা এবং বিরোধিতার প্রতি চরম অসহিষ্ণু ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয়ে ও নির্দেশে তাঁর বিরুদ্ধে রকমারি অপপ্রচার, ব্যঙ্গোক্তি এবং কুকথার বিরাম নেই। সেই বিষাক্ত অসহিষ্ণুতা এখন নতুন কৌশল খুঁজে পেয়েছে, তেরো ডেসিম্যাল জমিতে প্রচণ্ড তৎপরতায় এবং বিদ্যুৎগতিতে বিষবৃক্ষের চাষ হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এই অন্যায় অমর্ত্য সেনের যথার্থ মর্যাদা বা সম্মানকে স্পর্শও করতে পারবে না, এই আচরণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্তারা— এবং তাঁদের পশ্চাদ্বর্তী পুতুলনাচের কারিগরেরা— নিজেদেরই অপমান করে চলেছেন। কিন্তু তাতে তাঁদের সম্ভবত কিছুমাত্র যায় আসে না। রবীন্দ্রনাথ ‘নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারানো’র কথা বলেছিলেন। রাষ্ট্রীয় আবর্জনাকুণ্ডের স্রষ্টা এবং তদীয় অনুচরদের কাছে কথাটার আদৌ কোনও অর্থ আছে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy