অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানের স্কুল থেকে নানা রকম চিঠি বা বিজ্ঞপ্তি পেয়েই থাকেন। কিন্তু কলকাতার একটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি অভিভাবকদের কাছে যে বার্তা পাঠিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। সমীপবর্তী একটি বড় আধুনিক ‘মল’ থেকে কিছু দিন ধরেই ওই বিদ্যালয়ের পরিচালকদের কাছে এই মর্মে বহু অভিযোগ আসছে যে, স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত কিছু ছাত্রছাত্রীকে সেখানে অশোভন আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে এবং তাদের মুখে শোনা যাচ্ছে আপত্তিকর কথাবার্তা। অতঃপর স্কুল থেকে অভিভাবকদের জানানো হয়েছে যে, তাঁদের সন্তানেরা স্কুলের পোশাক পরে ওই মলটিতে গেলে তাঁরা যেন সঙ্গে থাকেন এবং তারা যাতে যথাযথ আচরণ করে তার দায়িত্ব নেন। তদুপরি, স্কুলের সময়ে যেন ছাত্রছাত্রীদের সেখানে আদৌ দেখা না যায়, কারণ তখন তাদের স্কুলে থাকার কথা, বাইরে নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের ওই বার্তায় বলা হয়েছে, “স্কুলের ইউনিফর্মকে সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে ধারণ করা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রাথমিক দায়িত্ব।”
কথাটি অত্যন্ত মূল্যবান। স্কুলের নির্ধারিত পোশাক কেবল পরিচিতির সূচক নয়, সেই পরিচিতির গভীরে প্রতিষ্ঠানের যে মর্যাদা নিহিত থাকে তার প্রতীক। এই প্রতীক এক দিকে শিক্ষার্থীদের চেতনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্মতার বোধটিকে লালন করে, অন্য দিকে বাইরের জগতের কাছে সেই একাত্মতার অভিজ্ঞান হয়ে ওঠে। বস্তুত, সেটিই ছাত্রছাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতির সবচেয়ে স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য অভিজ্ঞান, যা নিজেই নিজেকে চিনিয়ে দেয়। ঠিক সেই কারণেই, জনপরিসরে কোনও স্কুলের পোশাক পরিহিত শিক্ষার্থী যদি অশোভন কোনও আচরণ করে, তা কেবল তার নিজের অমর্যাদার ব্যাপার থাকে না, ওই বিদ্যালয়ের মর্যাদাও তখন লঙ্ঘিত হয়— দর্শকের ধারণা জন্মায় যে, স্কুলটিই সেই আচরণের দায়ে দায়ী। এই ধারণা কতটা সঙ্গত, কতটা নয়, আজকের পৃথিবীতে ছাত্রছাত্রীর ব্যক্তিগত চেতনা, বোধ বা আচার-আচরণের কত শতাংশ স্কুলের হাত থাকে, সেই সব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে, কিন্তু সামাজিক ধারণা কেন বাধ্যতে? অতএব আলোচ্য নির্দেশিকাটি কেবল যুক্তিসঙ্গত নয়, জরুরি। স্কুলের পরিচালকদের যে অভিভাবকদের কাছে আদৌ এমন নোটিস পাঠাতে হয়েছে, সেটাই কী পরিমাণ উদ্বেগের বিষয়, অভিভাবকরা— এবং তাঁদের সন্তানসন্ততিরাও— তা ভেবে দেখলে ভাল করবেন।
এখানেই পরবর্তী এবং গভীরতর প্রশ্ন। যে প্রতিষ্ঠানে তারা পড়ছে, তার মর্যাদা সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই পর্যাপ্ত সচেতনতা আছে কি? থাকলে, স্কুলের পোশাক গায়ে রেখে দৃষ্টিকটু এবং শ্রুতিকটু আচরণের বহু নজির বোধ করি যত্রতত্র প্রকট হয়ে উঠত না। মনে রাখতে হবে, একটি স্কুলের নির্দেশিকা সংবাদ হয়েছে, কিন্তু সমস্যাটি এখন বহুলপ্রচলিত। স্পষ্টতই, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতা নিয়ে বড় রকমের ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। প্রশ্নটি নিছক আচরণে সংযম আনার নয়, সেই আচরণের উৎস সন্ধানেরও। বলা নিষ্প্রয়োজন, সেই সন্ধানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঙ্গনে সীমিত রাখলে চলবে না, বৃহত্তর সমাজের পরিসরটিতেও দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। জনপরিসরে কোথায় কখন কার পক্ষে কোন আচরণ শোভন ও সঙ্গত, কোন আচরণ নয়, তার অনেকখানিই স্থানকাল-সাপেক্ষ। বিশেষত, আজকের পৃথিবীতে অল্পবয়সিদের স্বাধীনতাকেও অতীতের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি, তাদের উপর অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা এবং অহেতুক খবরদারি চালানো কখনওই সমর্থন করা চলে না। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা দরকার, স্বাধীনতা যেন যথেচ্ছাচার বা বিশৃঙ্খলার দোহাই হয়ে না দাঁড়ায়। এখানেই স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধের গভীর সম্পর্ক। ছাত্রছাত্রী তথা তরুণ প্রজন্মের চেতনায় সেই দায়িত্ববোধ যত প্রবল এবং সুস্থিত হবে, তাদের আচরণও ততটাই সঙ্গত হয়ে উঠবে। জনপরিসরে যথেচ্ছাচার যে আধুনিকতার সূচক নয়, বরং তাতে যে আত্মমর্যাদার হানি ঘটে, এই ধারণাটি অধুনা এ দেশের সামাজিক পরিসরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই পরিবেশে অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সঙ্গে সহৃদয় কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলা জরুরি। প্রয়োজনে শাসন করাও নিশ্চয়ই জরুরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— চৌকিদারের শাসন নয়, অভিভাবকের শাসন। অবশ্যই শিক্ষকেরও, তিনিও অভিভাবক বইকি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)