ঐতিহ্যই বটে। এক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে অপর এক ঐতিহ্যের সাড়ম্বর উদ্যাপন চলল ১ সেপ্টেম্বর, কলকাতার রাজপথে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিটি ইউনেস্কো-প্রদত্ত। আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার দুর্গাপুজো। এই স্বীকৃতি গর্বের, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার ধন্যবাদজ্ঞাপনে যে ভাবে ভরদুপুরে মধ্য কলকাতা স্তব্ধ হল, বহু স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল হল, দুর্ভোগ এড়াতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধই রইল, আগেভাগে অফিস ছুটি দেওয়ার প্রশাসনিক ‘অনুরোধ’ প্রেরিত হল, সেই ঐতিহ্যটিও কি একান্ত ভাবেই শহর কলকাতার নয়? এ শহর জানে কী ভাবে আনন্দে, উৎসবে, প্রতিবাদে, স্মরণে যখন-তখন শহরের প্রাণকেন্দ্রটিকে সম্পূর্ণ অচল রাখতে হয়। বস্তুত এ-হেন অনন্য ধারাটি, যা কলকাতার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে, বিশ্বের অন্য কোনও সভ্য শহরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এও এক রকম ‘হেরিটেজ’ বইকি!
অবশ্য, সামান্য কারণে শহর অচল রাখার প্রবণতাটি যে তৃণমূল জমানায় উদ্ভূত, তা বললে সত্যের অপলাপ হবে। অতীতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকান সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ, শহর-অচল করা মিছিলের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। বস্তুত, বাম আমলে রাস্তা আটকে মিটিং-মিছিল-সমাবেশের প্রাবল্যে লাগাম দিতে এক সময় আদালতকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল— কাজের দিনে রাস্তা বন্ধ করে মিটিং-মিছিল-সমাবেশ চলবে না। সুতরাং, জমি প্রস্তুত ছিলই। পরবর্তী কালে পরিবর্তনের সরকার বঙ্গজীবনে কর্মসংস্কৃতি পুনরুজ্জীবনের ডাক দিলেও হুজুগের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তনের মানসিকতা দেখায়নি। বরং তাতে সার, জল দিয়ে আরও পুষ্ট করেছে। তাই প্রতিবাদ মিছিল থেকে শুরু করে পুজোর বিসর্জন, ধর্মীয় উদ্যাপন, ভোটের প্রচার, জেতার আনন্দ, শহিদ স্মরণ— কাজের দিনে শহরের পথে হয়রান হওয়াই নাগরিকের ভবিতব্য। দুর্গাপুজোর পথ-যন্ত্রণা নির্দিষ্ট চার দিন অতিক্রম করে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর ২১ জুলাই ক্যালেন্ডারে অঘোষিত ছুটির দিন হিসাবে নির্দিষ্ট হয়েছে। শুধু ওই দিন নয়, একটি দলীয় কর্মসূচিকে ঘিরে তার আগে পরের আরও বেশ কিছু দিন যে ভাবে কলকাতা-সহ অন্য জেলারও পথঘাটে, গণপরিবহণে শাসক দলের পেশিশক্তির আস্ফালন চলে, তা দেখে চমৎকৃত হতে হয়। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানীর এমন অনন্য রূপটি অবশ্যই স্বীকৃতির দাবি রাখে।
কিন্তু অপ্রিয় দৃশ্যগুলি যে কিছুতেই ঢাকে না। যেমন এই ঢাক-ঢোল, বরণডালার আড়ালে চাপা পড়ে না সার সার থমকে থাকা গাড়ির মাঝে অপেক্ষারত অ্যাম্বুল্যান্সের ছবি। সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছতে না-পেরে যাঁদের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেল, গণপরিবহণ স্তব্ধ থাকায় যাঁদের হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দিতে হল, কিংবা যে সমস্ত রোগীর সময়মতো চিকিৎসা শুরু হল না, প্রশাসন কি তাঁদের জন্য নয়? উৎসব যেমন সবার, পথের অধিকারটিও তো সকলের প্রাপ্য। কেন তা হলে বার বার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলিকে বন্ধ করে প্রশাসন সেই অধিকারে হাত দিতে চায়? শহরে কি ধন্যবাদজ্ঞাপন, শহিদ স্মরণের জায়গা কম পড়েছে? অবশ্য এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখন নয়। এখন তো বাজাও ঢাক, বাজুক শঙ্খ। নির্দিষ্ট সময়ের এক মাস আগেই যে রাজ্যে পুজো শুরু হয়েছে।