—প্রতীকী ছবি।
কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শিল্প এ সব ক্ষেত্রে সঙ্কোচন তো চোখের সামনে, বাংলা কি মনের দিক থেকেও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে ক্রমশ? নইলে উদারবাদের সংস্কৃতি-চর্চার পীঠস্থান বলে গর্ব করে যে শহর, সেই কলকাতায় কেন এক আইন কলেজের শিক্ষিকাকে ইস্তফা দিতে হবে— হিজাব পরার জন্য? কলেজ কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক পোশাকবিধি অনুযায়ী শাড়ি সালোয়ার ট্রাউজ়ার্স সবই চলবে, হিজাব চলবে না, কারণ সেটি বিশেষ ধর্মীয় পরিচয়বাহী। অথচ শিখ ধর্মাবলম্বী কেউ কলেজে পড়ালে তাঁর পাগড়িতে আপত্তি নেই, হিন্দু মহিলাদের শাঁখা নোয়া সিঁদুরে তো নেই-ই। আগাগোড়া ধর্মীয় হওয়া সত্ত্বেও প্রচলনসিদ্ধ বলে এঁদের ঢালাও ছাড়, আর কেউ হিজাবে মাথা ঢাকলে তাঁকে বারণ করা বা বাধা দেওয়া— এ-হেন আচরণের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বিচারিতা ও বিভাজন, কলেজ কর্তৃপক্ষ কি তা বুঝছেন না? শিক্ষকের আসল পরিচয় ও কাজ যা, সেই পড়ানোর মূল্যায়ন না করে তাঁর পরিধেয় নিয়ে মাথা ঘামায় যে প্রতিষ্ঠান, সমাজে সে কোন শিক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে?
কলকাতার এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে বছর দুয়েক আগের কর্নাটককে— হিজাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে তৎকালীন বিজেপি সরকারের আমলে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আলোড়ন তৈরি হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনে। সরকারের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করতেই হচ্ছে, কারণ সমগ্র ঘটনাটিকে ছোপানো হয়েছিল বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতির রঙে; যে রাজনীতির মূল সুর সংখ্যালঘু ও তার ধর্মের প্রতি প্রবল অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ। হিজাব না-পরার মতোই হিজাব পরাও যে কারও ব্যক্তিগত ‘পছন্দ’ তথা ‘স্বাধীনতা’ হতে পারে, এবং নাগরিকের এই পছন্দ ও স্বাধীনতা যে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই দু’দিক থেকেই ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত— এই কথাটি সেই রাজনীতির বয়ান মেনে নিতে পারে না, পারেনি। সে কারণেই মেয়েদের হিজাব পরা নিয়ে চলেছে ব্যঙ্গবিদ্রুপ, হেনস্থা, এমনকি হুমকি, ভীতি প্রদর্শনও। কলকাতা কি সেই তালিকাতেই নাম লেখাচ্ছে— শিক্ষিকাকে ইস্তফা দেওয়ার পথে প্ররোচিত করে? একটি বস্ত্রখণ্ডে মাথা ঢাকা থাকল কি থাকল না, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হল, কলেজের পঠনপাঠনে কোন বিঘ্ন ঘটল? সবচেয়ে বড় কথা, যে প্রতিষ্ঠানে এই কাণ্ডটি ঘটল সেটি একটি আইন কলেজ। হিজাব ও ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে খোদ সুপ্রিম কোর্টেও যেখানে বিতর্কের পূর্ণ নিষ্পত্তি হয়নি, সেখানে আইনশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের এই আচরণ আইনেরই পরিপন্থী নয় কি?
উল্টো দিকে ইরানের সাম্প্রতিক নারী আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে কেউ বলতে পারেন, হিজাব না পরাই তো ভাল, যেমন বলছেন ইরানের বহু নারী। সেখানে রাষ্ট্র হিজাব চাপাতে চাইছে আর তাঁরা ভাঙতে চাইছেন রাষ্ট্রের ফতোয়া। হিজাব প্রত্যাখ্যান সেখানে মেয়েদের রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন প্রত্যাখ্যানের প্রতীক, তাঁদের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার। কলকাতার কলেজ-শিক্ষিকা বলেছেন, তিনি ইরানের মেয়েদের লড়াইয়েরও সমর্থক, আবার হিজাব যে নারীর ক্ষমতায়নে বাধা তা-ও তিনি মনে করেন না। বহু মেয়ে হিজাব পরে ক্রিকেট খেলছেন, সাঁতার কাটছেন, বিশ্বমঞ্চে যোগ দিচ্ছেন সগর্বে। নারীর অধিকার বা স্বাধীনতা তাতে আটকায় না; শিক্ষকতাই বা আটকাবে কেন? ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসরে পরোক্ষে ধর্মকে টেনে এনে কলকাতা এক লজ্জার নজির গড়ল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy