Advertisement
E-Paper

পলাতক

ছেলেমেয়েদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে বাবা-মায়েদের স্বার্থপর ও পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশাকে গত বছরেই ভারতের শীর্ষ আদালত কোটা প্রসঙ্গে এক মন্তব্যে তিরস্কার করে বলেছিল, দোষ তাঁদেরই, কোচিং সেন্টারগুলির নয়।

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৪ ০৮:১৬
Share
Save

হতাশা বা আক্ষেপ নেই, দুঃখ, হেরে-যাওয়ার ভাবও নয়। উনিশ বছরের ছেলেটি রাজস্থানের কোটা থেকে বাড়িতে মা-বাবার কাছে একটি মেসেজ পাঠিয়েছে, ডাক্তারি পড়ার সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসার পর দিন। লিখেছে, সে বাড়ি ছাড়ছে, আর পড়াশোনা করবে না। পাঁচ বছরের জন্য চলে যাচ্ছে সে, সঙ্গে আছে আট হাজার টাকা। তাকে খুঁজতে বারণ করে দিয়েছে, খুঁজলেও পাওয়া যাবে না কারণ সঙ্গে থাকা মোবাইলটি সে বেচে দেবে, ভেঙে ফেলবে সিম। আলাদা করে লিখেছে মা যেন চিন্তা না করেন তার জন্য, সে কোনও ‘ভুল পদক্ষেপ’ করবে না। তার কাছে সবার ফোন নম্বর আছে, প্রয়োজনে সে-ই যোগাযোগ করবে, বছরে এক বার তো বটেই। এক আশ্চর্য শান্ততায় সবাইকে ‘আশ্বস্ত’ করে রাজেন্দ্র মীনা নিরুদ্দেশ হয়েছে গত সপ্তাহে।

পরিবার ও সমাজের জন্য যে এ আশ্বাস নয়, ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কপর্বের শুরু, তা বলে বোঝানোর অবকাশ রাখে না। রাজস্থানের কোটা গত কয়েক বছর ধরেই সংবাদ শিরোনামে ‘আত্মহননের শহর’ হিসাবে, গত বছরেও সেখানে ২৯ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, পরিবারের প্রত্যাশা আর পড়াশোনার অমানুষিক চাপ সহ্য করতে না পেরে। ছাত্রাবাস ও পেয়িং গেস্ট-পরিষেবা দেওয়া বাড়ি থেকে সিলিং ফ্যান খুলে ফেলছেন হস্টেল কর্তৃপক্ষ ও বাড়ির মালিকেরা— মর্মন্তুদ এই দৃশ্য দেখা যাওয়ার পরেও কোটার কোচিং সেন্টারগুলিতে ছাত্রদের ঢল থামেনি। মৃত্যু, শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, নয়তো রাজেন্দ্রর মতো নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা চোখের সামনে দেখছে ভারতের নানা জায়গা থেকে সেখানে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীরা। কখনও কোনও ছাত্র ঘরে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির পথে, মা-বাবাকে বললে যদি বাড়ি ফিরতে না দেয় সেই আশঙ্কায়। বিহারের কোনও ছাত্রকে পাঁচ মাস পর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সুদূর কেরলে: কম সময়ে অনেক রোজগারের আশায় সে সেখানে বেছে নিয়েছিল অনলাইন ট্রেডিং, আইআইটি পরীক্ষার প্রস্তুতি ছেড়ে।

ছেলেমেয়েদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে বাবা-মায়েদের স্বার্থপর ও পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশাকে গত বছরেই ভারতের শীর্ষ আদালত কোটা প্রসঙ্গে এক মন্তব্যে তিরস্কার করে বলেছিল, দোষ তাঁদেরই, কোচিং সেন্টারগুলির নয়। এ যেমন সত্য, তেমনই আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, কোচিং সেন্টারগুলির কট্টর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ও কড়াকড়ির রুটিনও বহু ছাত্রছাত্রীর কাছে আতঙ্কের মতো। দূরদূরান্ত থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা একাকিত্বে ভোগে, কোচিং সেন্টারও তাদের শেখায় যে এখানে কেউ বন্ধু নয়, সকলেই প্রতিযোগী। এখানেই সমষ্টির বিরাট দায়— কেউ যার খবর রাখছে বা জানছে না, তাকে প্রাণের স্পর্শটুকু দেওয়া। অর্থ, সময়, শ্রম ও উৎপাদন-ব্যবস্থার পাকেচক্রে পড়ে যদি সমষ্টি সেই হাত বাড়াতে না পারে, তার ভার অবশ্যই নিতে হবে রাষ্ট্রকে। কোচিং সেন্টারগুলি শুধু পড়াশোনা ও পরীক্ষার নিয়মকানুন চাপিয়ে দেওয়ার কল হলেই চলবে না, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা শিক্ষার্থীদের শরীর-মনের খবর রাখে। দরকার এই লক্ষ্যে সরকারি নজরদারি, নিয়মিত রিপোর্ট, সহমর্মী পদক্ষেপ। আসল পলাতক কে— রাজেন্দ্র ও তার মতো সম্ভাবনাময় তরুণ জনসম্পদ, না কি দায় এড়ানো সমাজ ও রাষ্ট্র, সেই প্রশ্নটি করতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Medical Student NEET Kota

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}