Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Mayanmar

একটি কবিতার জন্ম

অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ, উভয়ের স্মৃতিতেই কবি বর্তমান। এখানেই সাহিত্যের নীতি ও ন্যায্যতা!   

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২১ ০৫:০১
Share: Save:

কবিতার উচ্চভূমে পৌঁছাইতে কয়টি সোপান অতিক্রম করিতে হয়? মায়ানমারের মৌলামিন শহরের সুউচ্চ কায়াকথিন প্যাগোডায় এই প্রশ্নের উত্তর মিলিতে পারে। প্যাগোডা বা বৌদ্ধ স্তূপটি একটি পাহাড়ের উপর, ওইটিই শহরের সর্বোচ্চ স্থান। সোপান বাহিয়া অনেকে সেখানে দিনান্তে অস্তরাগের শোভা দেখিতে যান। কলিকাতা হইতে জাহাজে চাপিয়া জাপান ও আমেরিকার পথে রাডইয়ার্ড কিপলিংও ১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে সেখানে গিয়াছিলেন। বম্বেতে জন্মানো ইংরেজ সন্তান তখন ২৪ বৎসরের তরুণ। লাহৌর হইতে ইলাহাবাদ সাংবাদিকতার পেশায় টো টো করিয়াছেন; পাশাপাশি গল্প, কবিতাও লিখিতেছেন। জোব চার্নকের ধূলি, ধোঁয়া, প্লেগ রোগে আক্রান্ত কলিকাতা শহরটিকে তাঁহার মোটেও ভাল লাগে নাই— স্থানীয়েরা শহরের উন্নতিবিধানে কিছু করে না, কেবল এডমন্ড বার্কের নকলে বক্তৃতাবাজি করে। কিপলিং লিখিয়াছিলেন, শহরটি পরিকল্পনাহীন ভাবে সুযোগমাফিক এখানে-সেখানে বাড়িয়াছে— ‘চান্স ডিরেক্টেড, চান্স ইরেক্টেড’। কিপলিং নিঃসন্দেহে মদগর্বিত সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন, কিন্তু কলিকাতা সম্বন্ধে ওই শব্দবন্ধ আজও অতুলনীয়। এখানেই কবিতার জয়, কবির জয়!

মৌলামিনের ওই সর্বোচ্চ স্থানের কয়েক ধাপ উঠিয়া এক বর্মি তরুণীকে দেখিয়া কিপলিং মুগ্ধ হইয়াছিলেন। মুগ্ধতা প্রেমে পৌঁছাইবার অবসর পায় নাই, কারণ পর দিনই জাহাজ ছাড়িবে। কিন্তু পরের বৎসর কিপলিং তাঁহার ‘মান্দালয়’ কবিতার শুরুতেই নামহীন মেয়েটিকে অমর করিলেন— ‘বাই দি ওল্ড মৌলামিন প্যাগোডা... দেয়ার ইজ় আ বার্মিজ় গার্ল।’ অতঃপর ইংরেজ সেনানীটি মান্দালয়ে বর্মা দখলের যুদ্ধে যাইবার পথে তরুণী যেন তাহাকে হাতছানি দেয়, ‘কাম ইউ ব্যাক, কাম ইউ ব্রিটিশ সোলজার।’ শতবর্ষ পরে আজও এই কবিতা লইয়া কত মুনির যে কত মত! কবিতা দুই বার সিনেমায় রূপান্তরিত হইল; ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা উহা লইয়া গান বাঁধিলেন; এলিয়ট বলিলেন চমৎকার কবিতা; তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাইদ আবার ছত্রে ছত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ খুঁজিয়া পাইলেন। কারণ, যুদ্ধগামী তরুণের মনে হইয়াছে, এই মেয়ের নাম আর বর্মার রাজা থিবোর রানির নাম একই। সুপ্রিয়ালাত! ব্রিটিশ সেনারা যে মান্দালয় দখল করিয়া থিবো ও সুপ্রিয়ালাতকে পরবর্তী কালে ভারতের রত্নগিরিতে নির্বাসন দিল, তাহা সর্বজনবিদিত। অমিতাভ ঘোষের দ্য গ্লাস প্যালেস উপন্যাসে সেই ঔপনিবেশিক দখলদারির জীবন্ত বর্ণনা আছে। হাল আমলে অমর্ত্য সেন তাঁহার আত্মজীবনীর শৈশবস্মৃতির মান্দালয় পর্বেও কবিতাটির উল্লেখ করিলেন। এখানেই কবিতার জিত! তাত্ত্বিকরা ভাল-মন্দ নানা তত্ত্ব দিবেন, কিন্তু পাঠকের মনে সেই সব তত্ত্বকথা ছাপাইয়া মনোগ্রাহী ঝঙ্কার উঠিবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অবশ্য সঙ্গত কারণেই নোবেলজয়ী ইংরেজ কবির কবিতা বিশ্লেষণে যান নাই। বরং, বাল্যকালে এই কবিতার ভৌগোলিক বাস্তবতা লইয়া তাঁহার রসায়নবিজ্ঞানী পিতা নানা সংশয় প্রকাশ করিতেন, তাঁহার মনে আছে।

কবিতা লইয়া বিভিন্ন সময়ে এই ভাবেই বিভিন্ন পাঠ-প্রতিক্রিয়া হইয়া থাকে। ‘মান্দালয়ের পথে যেখানে নৌবহর ছিল’, মৌলামিন প্যাগোডার সেই কবিতায় লিখিয়াছিলেন কিপলিং। বাস্তবে দুইটি শহরের দূরত্ব আট হাজার কিমির অধিক, সেখানে ‘ব্রিটিশ সেনানী, ফিরিয়া আইস’ বলিয়া কোনও মেয়ে হাতছানি দিতে পারে না। চিন সাগর পার করিয়া যেখানে বজ্রের ন্যায় ভোর আসে, ইহাও ভুল। চিন সাগরের সহিত মান্দালয়ের কোনও সম্পর্ক নাই। ধান রোপণের সময় ‘কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা’ লিখিবার জন্য একদা রবীন্দ্রনাথকেও কম হাসিঠাট্টা সহ্য করিতে হয় নাই। কবির উপমা সমকালীন পাঠকের কাছে অনেক সময় অধরা থাকিয়া যায়। পরবর্তী কাল সেই মাধুরী ধরিয়া দেয়। আমেরিকান লেখক সমারসেট মম যেমন বলিয়াছিলেন, মান্দালয় একটি কেবল নাম। কিন্তু নামটিতেই জাদু। কেহ আবার বলিয়াছেন, বর্মি কন্যা অচেনা ব্রিটিশ সেনাকে হাতছানি দেয়, এখানেই প্রেমের জয়। ঔপনিবেশিক বুটজুতার ব্যাখ্যা বেমানান। মান্দালয়বাসী বালক অমর্ত্যের মনে যেমন ভ্রান্ত ভূগোল সত্ত্বেও কবিতাটি ঝঙ্কার তুলিত। কবিতায় যাঁহারা রাজনৈতিক সঠিকতার সন্ধান করেন, তাঁহাদের জানা উচিত, মায়ানমারের নেত্রী আউং সান সু চি তাঁহার পুত্রের নাম রাখিয়াছেন কিপলিংসৃষ্ট এক বালকের নামে— কিম! অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ, উভয়ের স্মৃতিতেই কবি বর্তমান। এখানেই সাহিত্যের নীতি ও ন্যায্যতা!

যৎকিঞ্চিৎ

জখম প্রতিদ্বন্দ্বী জানমার্কো তামবেরিকে হারাতে রাজি হলেন না কাতারের মুতাজ় বার্শিম। ভাগ করে নিলেন অলিম্পিক্সে হাই জাম্পের সোনা। ক’জন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিটের নামই বা গণস্মৃতিতে থাকে? বার্শিমের নামটা থাকবে। ইতিহাসে স্মরণীয় হওয়ার জন্য যে ভাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও ভাল মানুষ হওয়া বেশি জরুরি, এই কথাটা কিন্তু এই বারও দুনিয়া শিখবে না। সন্তানকে শেখাব, ক্লাসে স্যর প্রশ্ন করলে বার্শিম আর তামবেরির নামটা যেন পাশের ছেলেটাকে বলিস না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mayanmar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE