ই ংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘জাস্টিস ইজ় রুটেড ইন কনফিডেন্স’— যাহার অর্থ, জনগণের আস্থাতেই সুবিচারের ভিত্তি। মানুষ যদি বিচারপ্রক্রিয়ায় আস্থা না রাখিতে পারে, তবে বিচারবিভাগের কর্তব্য, নিজেকে প্রশ্ন করা। ভারতীয় গণতন্ত্র এখন সেই পর্যায়ের মধ্য দিয়া যাইতেছে, বিচারকরা নিজেরাই নিজেদের বিভাগ লইয়া সংশয় প্রকাশ করিতেছেন। ভারতীয় নাগরিক আগেও দেখিয়াছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি মুক্তপরিসরে প্রচারমাধ্যমের নিকট বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা লইয়া সংশয় প্রকাশ করিতেছেন। প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটিল সম্প্রতি মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বদলি করিবার নির্দেশের প্রেক্ষিতে। দৃষ্টান্তবিহীন ভাবে, কলেজিয়ামকে চিঠি লিখিয়া মাদ্রাজ হাই কোর্টের ৩১ জন বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রশ্ন তুলিলেন, নিয়োগের পর এত কম দিনের মধ্যে এমন বদলির নির্দেশ কেন— তাহাও আবার এমন এক প্রধান বিচারপতিকে, যিনি কর্মদক্ষতার জন্য খ্যাতিমান? সঙ্গত ভাবেই তাঁহারা প্রশ্ন উঠাইয়াছেন, ইহা তো যে কোনও আদালতের বিষয় নহে, হাই কোর্টের বিষয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের হাই কোর্ট, যেখানে বিপুল সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ মামলা আসিয়া জড়ো হয়, ৭৫ জন বিচারপতি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। তামিলনাড়ু হইতে মেঘালয়ের মতো ছোট রাজ্যে পাঠাইয়া দেওয়া— যেখানে বিচারকের সংখ্যা মাত্র তিন, মামলার সংখ্যা নগণ্য এবং গুরুত্ববিচারে তুলনীয়ই নহে— ইহা কি তবে শাস্তিমূলক বদলি, এই অনুমানই করিতে হয়? যদি তাহাই হয়, কিসের শাস্তি? প্রধান বিচারপতি কোনও নীতিরীতি ভঙ্গ করেন নাই, বরং নৈপুণ্যের সহিত কাজ নির্বাহ করিয়াছেন, করিতেছেন। তবে কি অনুমান করিতে হইবে, কেহ বা কাহারা তাঁহার বিচার পছন্দ করেন নাই বলিয়াই এমন ঘটিল? ইহা কি গণতন্ত্রের অন্যতম মূল স্তম্ভ বিচারবিভাগের জন্য মঙ্গলদায়ক বার্তা?
বাস্তবিক, গুজরাত হইতে রাজস্থান, তামিলনাড়ু হইতে পঞ্জাব, পর পর বিচারপতি-বদলির কিছু সিদ্ধান্ত সচেতন নাগরিক সমাজকে উদ্বেগে ফেলিয়াছে। স্বচ্ছতা রাখিবার প্রয়োজনটি হয় বিস্মৃত হইয়াছে, নতুবা তত গুরুত্বপূর্ণ ঠেকিতেছে না। মনে পড়িবে, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতীকটির মধ্যেই খোদিত আছে ‘যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’। ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ এখানে মঙ্গলদায়ী সুবিবেচনা, শাস্ত্রমুখী হিন্দুধর্ম নহে— হয়তো কার্ডধারী হিন্দুত্ববাদীদেরও তাহা ঢোঁক গিলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। যে বিভাগ নিজেই নিজের বিবেচনা লইয়া প্রশ্ন করিতেছে, তাহার উপরেই তো অবশিষ্ট সমাজ বিষয়ে সুবিবেচক হইবার ভার। ‘ধর্ম’পালন তো প্রতি ক্ষেত্রের নীতি হওয়া জরুরি, এবং সেই ভাবেই বাহিরের সমাজের নিকটও প্রতিভাত হওয়া জরুরি।
উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। বিশেষত এমন এক সময়ে, যখন রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ক্রমশই ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দেখিতেছে, বৈষম্য ও বিদ্বেষের প্রস্ফুরণ দেখিতেছে, নাগরিক সমাজের অধিকার উপর্যুপরি হরণ করিতেছে। বর্তমান সময়কে ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ বলা এখন আর বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই, বৃহত্তর সমাজের অনেকাংশই সেই বিষয়ে আজ নিশ্চিত, উদ্বিগ্ন, ত্রস্ত। এমন একটি সময়ে বিচারবিভাগই জনগণের আস্থা রাখিবার শেষ আশা। সেই শেষ ‘মোহিকান’ও যদি এই ভাবে অনাস্থা-গ্রস্ত হইয়া পড়ে, ভারতীয় জনসমাজের পক্ষে তাহাকে ভয়ঙ্কর দুর্দিন বলিতে হয়। বিবিধ প্রসঙ্গে দেশের সুপ্রিম কোর্ট গত কিছু বৎসর ধরিয়া একাধিক বার বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব মনে করাইয়া দিয়াছে, জনসাধারণের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা রাখিবার দায়টি উচ্চারণ করিয়াছে। মহামান্য আদালতের সেই উচ্চারণই এখন আবার স্মরণ করা জরুরি। ‘ধর্ম’-র স্বার্থে। গণতন্ত্রের ধর্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy