E-Paper

দ্রৌপদীর দেশ?

প্রধানমন্ত্রী নিজেও বড় প্রশ্নের মুখে। তিনি যদি ঘটনার তীব্রতা সম্পর্কে অবহিত না থেকে থাকেন, তা তাঁর ভীতিপ্রদ দায়িত্বস্খলন।

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪১
An image of sexual harassment

—প্রতীকী চিত্র।

মাননীয় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু হয়তো খেয়াল রাখেননি, কিন্তু ঘটনা হল, এই মুহূর্তে ভারতের ইতিহাস তাঁর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিরাট ব্যঙ্গচিহ্নের আকার নিয়ে। সেই স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের উচ্চতম রাষ্ট্রিক পদে আসীন তিনি, যেখানে কেবল কতিপয় কৌরব দুর্বৃত্ত দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে পাপাচারে উন্মুখ হয় না, যেখানে শত শত হিংস্র মানুষ প্রকাশ্য দিবালোকে একযোগে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে তাড়া করে, সহর্ষে সবলে সদলে নির্যাতন করে নিজেদের জাতির, গোষ্ঠীর, অঞ্চলের, দেশের রাজনীতির ‘পৌরুষ’ উদ্‌যাপন করে। সেই দেশের রাষ্ট্রনেত্রী তিনি, যেখানে এমন ঘটনার অস্তিত্ব জানার পরও মানুষ সত্য ও তথ্য চাপা দিতে তৎপর হয়। সেই দেশের নেত্রী তিনি যেখানে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া দূরস্থান, মাসের পর মাস অমানুষিক অত্যাচারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন নারীশরীর, কর্তিতমুণ্ড নরশরীর দেখেও দেশের নেতারা, রাজ্যের নেতারা নিশ্চেষ্ট, নীরব হয়ে বসে থাকেন, এমনকি সহাস্য ও প্রগল্‌ভ দৃপ্ততায় বিশ্বমোহন হয়ে ঘুরে বেড়ান।

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু তাঁর নামপরিচয় ও লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে প্রান্তিক সামাজিক পরিচয়টি নিয়েও অস্তিত্বসঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারেন, কেননা এক দিকে যেমন দলিত পরিচিতির কারণে তাঁর মতো রাষ্ট্রপ্রধান আজ ভারতের গৌরব ও মর্যাদার মূর্ত প্রতীক, অন্য দিকে, সেই প্রান্তিক পরিচয়ের দাম দিতেই আজ মণিপুরের মেয়েরা এই ভাবে সর্বসমক্ষে উলঙ্গ হয়ে, তাড়িত হয়ে, ধর্ষিত হয়ে ফিরছে। গত দুই দিনে সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের মাথা হেঁট করেছে এই ভয়ঙ্কর ভিডিয়ো। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের অমৃত মহোৎসবের কাল পূর্ণ হতে এখনও মাসখানেক বাকি। মণিপুরের এই উলঙ্গ কন্যা দু’টিই এই বছরের সবচেয়ে নাড়িয়ে-দেওয়া চলছবি— অমৃতযুগের তুঙ্গমুহূর্ত— হিসাবে থেকে যাবে। আর থেকে যাবে অসংখ্য প্রশ্ন। বৃহত্তর জনতার কাছে এই ভিডিয়োর অস্তিত্ব জানা না থাকলেও প্রশাসনের কাছে নিশ্চয়ই তা ছিল। সম্ভবত সেই কারণেই ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যাতে এমন আরও দৃশ্য ছড়িয়ে না পড়ে। তাতে যে কাজ হয়নি, তিন মাসব্যাপী নরককাণ্ডই তার প্রমাণ। এক মাস আগে জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে অভিযোগ পৌঁছেছিল বলেও সংবাদ। কেন কাজ হয়নি তাতেও? ভিডিয়োর অস্তিত্বই বুঝিয়ে দেয়, অপরাধী নির্ণয় করে প্রশাসনিক পদক্ষেপণের কাজটি অভাবনীয় রকমের কঠিন ছিল না। সে ক্ষেত্রে আশি দিনব্যাপী এই নিশ্চুপতার অর্থ কী? বিশেষ কোনও জনগোষ্ঠীকে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত বর্বরতায় মাতার সুযোগ করে দেওয়াও কি অন্যতম লক্ষ্য হয়ে থাকতে পারে? মেইতেই-কুকি সংঘর্ষের উৎস ও স্বরূপ নিয়ে অনেক চর্চা হলেও মণিপুরের শাসক দলের রাজনীতি যে এই সংঘর্ষের মধ্যে ঠিক কী ভূমিকা পালন করছে, তার এখনও কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এমন ভিডিয়োর সাক্ষাৎ উপস্থিতির মধ্যে কেউ যদি বিজেপি সরকারের প্ররোচক ভূমিকাটি খুঁজে পান, তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।

প্রধানমন্ত্রী নিজেও আজ বড় প্রশ্নের মুখে। তিনি যদি ঘটনার তীব্রতা সম্পর্কে অবহিত না থেকে থাকেন, তা তাঁর ভীতিপ্রদ দায়িত্বস্খলন। আর তিনি যদি সব জেনেও এত দিন অন্যান্য কাজে ব্যাপৃত থেকে মণিপুরের বিষয়ে উদাসীন থেকে থাকেন, তা হলে দেশের নেতৃত্বযোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন। তবে কিনা, শেষ বিস্ময়টি অবশ্যই ভারতীয় সমাজকে নিয়ে। যুগে যুগে দেশে দেশে নারীশরীর যে সর্বোত্তম যুদ্ধক্ষেত্র, তাকে ছিন্নভিন্ন করেই যে বিজিতের প্রতি বিজয়ের চূড়ান্ত বার্তা, এ সব কথা জানা। এ দেশের রাজনীতির সেই নারীবিকারের ছবি ফুটিয়ে তুলতেই মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনির নাম ‘দ্রৌপদী’। তবু একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির নামে কতটা বিকৃত পৌরুষ প্রদর্শন আজও সম্ভব, এবং কতটা ঘটার পরও সমাজের পক্ষে আবার নিশ্চিন্তে প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতায় ফিরে যাওয়া সম্ভব, তার তুলনারহিত দৃষ্টান্ত দিয়ে গেল মণিপুর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Manipur Violence Sexual Harassment Droupadi Murmu

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy