E-Paper

চক্রবৎ?

র‌্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভূমিকা গৌণ; ক্ষমতা, তার বহিঃপ্রকাশ ও অপব্যবহারের তৃপ্তিই মুখ্য।

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৩ ০৫:৪৭
An image of Jadavpur University Hostel

যাদবপুরের ছাত্রাবাস। —ফাইল চিত্র।

যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ— এই লোকপ্রবাদই কি তবে প্রমাণসিদ্ধ, সত্য? ক্ষমতা হাতে পেলে ক্ষমতার অপব্যবহারই নিতান্ত স্বাভাবিক? যাদবপুরের ছাত্রাবাসে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় গণপরিসরে যুগপৎ যে অনুভূতিগুলি ঘোরাফেরা করছে তার অন্যতম এই ‘বিস্ময়’: আজ যে উঁচু ক্লাসের বা প্রাক্তন ছাত্রদের বিরুদ্ধে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, প্রথম বর্ষে তারাই হয়েছিল র‌্যাগিংয়ের শিকার। আজ যে র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে, উঁচু ক্লাসে উঠে সে-ই ‘সিনিয়র’-রূপে ফিরে আসবে র‌্যাগিং করতে। এ এক অমোঘ চক্র, যেখানে শিকারি ও শিকার, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন উভয়েই তাকিয়ে আছে সময়ের দিকে; ক্ষমতাবান একদা ক্ষমতাহীন ছিল বলেই আজ সুযোগ বুঝে ‘হাতের সুখ’ করে নিচ্ছে, আর ক্ষমতাহীনও জানে শুরুর একটা বছর কোনও মতে পার করাই লক্ষ্য, তারও শিকারি হয়ে ওঠা ‘সময়ের অপেক্ষা’।

জনমনকে আরও যা অবাক করেছে তা হল, র‌্যাগিংয়ে জড়িত বা অভিযুক্ত ছেলেগুলি প্রায় সকলেই ছোট শহর, মফসস্‌ল বা গ্রাম থেকে আসা। হস্টেল কলকাতার বাইরের পড়ুয়াদের জন্যই, সেখানে জুনিয়র-সিনিয়র সকলেই দূর শহর বা গ্রাম থেকে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় বিচিত্র আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সমাগমস্থল, খাস কলকাতার কেতাদুরস্ত ছাত্রছাত্রীদের পাশে গ্রাম-মফস্‌সলের ছেলেমেয়েরা সেখানে খানিক জড়সড় থাকে। কিন্তু সে কারণেই কি ছাত্রাবাসে জুনিয়র ছাত্রদের আরও আগলে রাখা, স্বস্তিতে রাখাই সিনিয়রদের দায়িত্ব নয়? বিশেষত সেই সিনিয়রদের, যারা এই আড়ষ্টতা হীনম্মন্যতা ও অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা-অবহেলাও পেরিয়ে এসেছে মাত্র কিছু দিন আগে? যাদবপুরে, এবং আরও বহু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসেই তার পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে র‌্যাগিংয়ে মেতে উঠছে এই উঁচু ক্লাসের ছাত্ররাই, দূরে গ্রামের বাড়িতে অভিভাবকেরা তা জানতেও পারছেন না। আবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ-করা লাজুক মুখচোরা ছেলেটিকে এমন কোনও অভিভাবকই সরল বিশ্বাসে সঁপে দিয়ে যাচ্ছেন একই এলাকা থেকে আসা কোনও সিনিয়র ছাত্রের কাছে, র‌্যাগিং-যন্ত্রের মুখে।

এ থেকেই স্পষ্ট, র‌্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ভূমিকা গৌণ; ক্ষমতা, তার বহিঃপ্রকাশ ও অপব্যবহারের তৃপ্তিই মুখ্য। যাদবপুরের ঘটনার সূত্রেই মনোবিদরা দেখাচ্ছেন সমাজের অন্য পরিসরগুলিতেও র‌্যাগিংয়ের সমধর্মী ছবি— নতুন বৌ হয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার মেয়েটিই কালক্রমে শাশুড়ি রূপে পুত্রবধূর উপর খড়্গহস্ত; কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা হওয়া মানুষটি ক্রমে উঁচু পদে আসীন হয়ে অধস্তন-পীড়নেও হয়ে উঠছেন অভিজ্ঞ। ছাত্রমহলে কান পাতলে শোনা যাবে, যে শিক্ষক নিজে ছাত্রজীবনে ভাল নম্বর পাননি, শিক্ষক হয়ে তাঁর নম্বর দেওয়ার হাতটিও হয়ে পড়ে কৃপণ। এই সব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ একশৈলিক একরৈখিক নয়, তার অন্দরে-কন্দরে রয়েছে মানব-মনস্তত্ত্বের জটিল ঘুরপ্যাঁচ, আলোআঁধারি। তাতে গোড়ার কথাটি মিথ্যা হয়ে যায় না— ক্ষমতা হাতে পেলে রাজনৈতিক দল থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত বিহ্বল লাগামছাড়া হয়ে পড়ার আশঙ্কাটি ষোলো আনা। ছাত্রসমাজও ব্যতিক্রম নয়, শুধু তারা এখনও অপরিণতমনস্ক বলেই পরিণতিটি বেশি ভয়ঙ্কর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jadavpur University Student Death Jadavpur University Hostel Students harassment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy