Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Election Campaign Strategy

ভোটের খিদে

খাদ্যের অধিকার, শিশুর অধিকারের সীমা ভোটের দিনক্ষণ দিয়ে নির্দিষ্ট করার চেষ্টা যে কতটা ক্ষুদ্রতার পরিচয়, সে বোধও যেন সরকার হারিয়ে ফেলেছে।

শাসক দলের ভোটের খিদে মিটে গেলে আর শিশুর পেটের খিদের মূল্য নেই সরকারের কাছে।

শাসক দলের ভোটের খিদে মিটে গেলে আর শিশুর পেটের খিদের মূল্য নেই সরকারের কাছে। প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:১৭
Share: Save:

শিশুর পুষ্টি অবশেষে নির্বাচনী লড়াইয়ের বিষয় হয়ে উঠল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে প্রতি স্কুলপড়ুয়া শিশুর জন্য সপ্তাহে কুড়ি টাকা বরাদ্দ করল রাজ্য সরকার। এই ঘোষণায় যতটুকু আশা জাগে, তা এক নিমেষে নিবে যায় এই খবরে যে, এই বরাদ্দের মেয়াদ মাত্র চার মাস। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সারা বছর এই বাড়তি বরাদ্দ দেওয়ার মতো তহবিল রাজ্য সরকারের নেই। অতএব ৩৭২ কোটি টাকার এই তহবিল কেবল জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের জন্য। তাঁর বার্তাটি স্পষ্ট— শাসক দলের ভোটের খিদে মিটে গেলে আর শিশুর পেটের খিদের মূল্য নেই সরকারের কাছে। এমন নির্লজ্জতার নজির ভারতের রাজনীতিতেও খুঁজে পাওয়া যাবে কি? নির্বাচনের আগে বহু রাজনৈতিক দলই নানা লোভনীয় প্রকল্প ঘোষণা করে। তৃণমূল দলও খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রভৃতি প্রকল্প, অথবা তার প্রতিশ্রুতি, বিভিন্ন নির্বাচনের আগে প্রচার করেছে। কিন্তু নির্বাচন মিটে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সরকারি সুযোগ-সুবিধে গুটিয়ে নেওয়া হবে, এমন বার্তা আগে কখনও মেলেনি। ভারতের রাজনীতিতে একটি কুপ্রথা দেখা যায়, তা হল, ভোটের আগে ঢালাও খাদ্যপানীয়ের ভোজ দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা। তৃণমূল সরকার যেন স্কুলের শিশুদের মিড-ডে মিলকে সেই স্তরে টেনে নিয়ে এল।

খাদ্যের অধিকার, শিশুর অধিকারের সীমা ভোটের দিনক্ষণ দিয়ে নির্দিষ্ট করার চেষ্টা যে কতটা ক্ষুদ্রতার পরিচয়, সে বোধও যেন সরকার হারিয়ে ফেলেছে। শিশুর পাতে সুখাদ্য পরিবেশনের উদ্যোগ থেকেও তাই কেবল স্বার্থসিদ্ধির দুর্গন্ধ উঠছে। মিড-ডে মিলে পুষ্টিকর, প্রোটিনযুক্ত খাবার সরবরাহের প্রতি তৃণমূল সরকারের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। মাথাপিছু এত সামান্য বরাদ্দে শিশুদের পাতে ডিম-মাংস দেওয়া সম্ভব নয়— শিক্ষকেরা বার বার এই অভিযোগ করলেও, রাজ্য সরকার তাতে কান দেয়নি। ২০১৯ সালের অগস্ট মাসে পূর্ব বর্ধমানে প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা বলেছিলেন, ডিমের দাম বেশি, তাই শিশুদের পেট ভরে ডাল-ভাত খাওয়ানো হোক। ২০২০-২১ সালে লকডাউনে স্কুল বন্ধ থাকাকালীন স্কুল থেকে প্রতি সপ্তাহে সরবরাহ হয়েছিল প্রধানত চাল আর আলু। সমাজকর্মীরা বার বার আপত্তি তুলেছিলেন যে, মিড-ডে মিলের জন্য কেন্দ্রের পাঠানো টাকার চাইতে কম মূল্যের খাবার বিতরণ করছে রাজ্য, এবং এই খাবারে শিশুর পুষ্টির প্রয়োজন মিটবে না। সে আপত্তিও নিষ্ফল হয়েছে। অতিমারিতে দারিদ্র, অপুষ্টির সঙ্কট তীব্র হয়েছিল, তবু শিশুর আহারে বরাদ্দ বাড়েনি। এখন দুয়ারে ভোট, তাই শিশুর পাতে মাংস, ফল দিতে ব্যস্ত রাজ্য। শিক্ষকরা আশঙ্কিত, বরাদ্দে কুলোবে না। কিন্তু মূল প্রশ্নটি রাজনৈতিক— শিশুর খাদ্যের অধিকারকে মান্যতা দিতে সরকার কী করছে? স্কুলের মধ্যাহ্নভোজে সুষম আহারের ব্যবস্থা নেতা-মন্ত্রীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় নয়— এ একটা অধিকারের প্রশ্ন। চার মাস দেব, আট মাস দেব না, এ কথা বলার এক্তিয়ার শিক্ষামন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর নেই। সপ্তাহে বাড়তি ২০ টাকা যদি শিশুদের প্রাপ্য হয়, তবে তা বারো মাসই প্রাপ্য। মানুষের অধিকারের প্রশ্নটিকে যে সরকার নিজের দাক্ষিণ্য বিতরণের প্রশ্ন করে তোলে, তাকে, আর যা-ই হোক, জনস্বার্থমুখী সরকার বলা চলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE