Advertisement
০২ মে ২০২৪
Social Media

সত্য সকলই সত্য?

ইতিহাসের ছল ধরে এই মিথ্যাচারের চর্চা ভারতীয় সমাজের কী ক্ষতি করছে তা সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই নজরে পড়বে।

phone

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৩
Share: Save:

ভারতে স্কুলপাঠ্য বইয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে ইতিহাসের বিকৃতি কিংবা নির্দিষ্ট অংশ মুছে দেওয়ার অভিযোগ আগেই উঠেছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদরাও সরব বহু দিন। সম্প্রতি আরও যে বিষয়টি ঘিরে রীতিমতো আশঙ্কা ঘনাচ্ছে তা হল, ইতিহাস বিকৃতিতে সমাজমাধ্যমের ভূমিকা— পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের অধিবেশনে যে কথাটি উঠে এল। ফেসবুক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ-এর জমানায় অসত্য বা ভুয়ো ইতিহাস রচনা অতি সহজ কাজ, সেই প্রবণতাও চার পাশে ক্রমবর্ধমান। ইতিহাস রচনার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে: জানা তথ্যগুলিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে না নিয়ে তাদের অনুপুঙ্খ ও ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে একাধিক মত ও তর্ক, যে বহুত্ব ইতিহাস-রচনাকে সমৃদ্ধ করে। ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণেরও আছে পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক পন্থা, আমার যা ভাল লাগে তাকে তুলে ধরে অপ্রিয় সত্য ও তথ্যকে ঢাকাচাপা দেওয়ার কাজ ইতিহাসের নয়। অথচ, সেই কাজটিই প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে সমাজমাধ্যমে; একপেশে মনগড়া গালগল্পকে ‘ইতিহাস’-এর নামে চালিয়ে ও চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মুহূর্তে তা পৌঁছে যাচ্ছে এক বিপুল জনতার হাতে, প্রভাবিত করছে জনমত, এমনকি ছাপ ফেলছে রাজনীতির পালাবদলেও।

এই ‘নতুন ইতিহাস’ রচনার প্রণোদনা যে রাজনৈতিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজেপির আমলে হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের আলোয় ভারতের অতীত-ইতিহাসকে শুধু দেখারই নয়, ঢেলে সাজানোর কথা ঘোষণা করছেন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা, প্রকাশ্যে বলছেন এত দিন যে ইতিহাস মানুষ পড়ে এসেছেন তা ফেলে দিয়ে নতুন ইতিহাস লেখা ও পড়ার কথা। তবে ইতিহাস ‘লিখতে’ গেলে জ্ঞানগম্যি ও এলেম লাগে, তা নেই বলেই ইদানীং ইতিহাস ‘মোছা’র কাজটি হয়ে দাঁড়িয়েছে আসল। এরই একটি দিক স্কুলের বইয়ে মোগল ইতিহাসকে অস্বীকার, রাজপুত ও হিন্দু ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করা, কিংবা মহাত্মা গান্ধীর হিন্দু জাতীয়তাবাদ-বিরোধিতা বা গুজরাত দাঙ্গার উল্লেখ মুছে দেওয়া। অন্য দিকটি ব্যাপকতর, সহজতরও বটে— সমাজমাধ্যমে মিথ্যা ও ভুয়ো তথ্যকে ঐতিহাসিক ঘটনার মোড়কে পুরে রটিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সুবিধা, সমাজের সর্ব স্তরে অতি সহজে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া যায়; সাধারণ মানুষ থেকে তথাকথিত শিক্ষিতজনকেও ‘অজানা বা অপ্রচারিত ইতিহাস’-এর ছলে সংশয়ী করে তোলা যায়, সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা বা জাতিবিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা যায়।

ইতিহাসের ছল ধরে এই মিথ্যাচারের চর্চা ভারতীয় সমাজের কী ক্ষতি করছে তা সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই নজরে পড়বে। যার হয়ে ওঠার কথা ছিল যোগাযোগের সহজ ও সুলভ মাধ্যম, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্বেষের আবাদভূমি: মহাকাব্যের নায়ক, জনপূজ্য দেবতা চরিত্রটি মাংসভোজী ছিলেন কি না তা নিয়ে সেখানে কুৎসিত বাগ্‌যুদ্ধ বাধে, মোগল আমলের শিল্প-ঐতিহ্য তুলে ধরলে বিধর্মী বলে নস্যাৎ করা হয়, ইতিহাস-আশ্রয়ী চলচ্চিত্রে দুই ধর্মের দু’টি মানুষের প্রণয় দেখানো হলে সমাজমাধ্যম ছেয়ে যায় বয়কট-আহ্বান ও কুরুচির বিজ্ঞাপনে। প্রকৃত তথ্য জানতে চাওয়া দূরস্থান— ইতিহাস কী, কী ভাবে তা লেখা হয়ে থাকে ও হয়ে এসেছে, মূলের সেই প্রক্রিয়াটি বুঝতে চাওয়ার মানসিকতা ও অভ্যাসও আজকের ভারতে সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE