ফাইল চিত্র।
ফের শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। রাজনৈতিক হিংসায় ভারতে এ রাজ্যের স্থান অবিসংবাদিত, প্রথম তিন দফার ভোট তাহা প্রমাণ করিল। পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট চলিতেছে, কিন্তু খুন, প্রহার, অগ্নিসংযোগ, ভীতিপ্রদর্শনে পশ্চিমবঙ্গের ধারেকাছে কেহ নাই। এ বার নির্বাচনী সন্ত্রাসের নূতন ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করিয়াছে রাজ্য— আপন নির্বাচনী এলাকায় আক্রান্ত হইতেছেন প্রার্থীরা। বিশেষত দুই মহিলা প্রার্থীর নিগ্রহ প্রত্যক্ষ করিয়া আজ বাঙালির লজ্জা রাখিবার জায়গা নাই। আরামবাগে সুজাতা মণ্ডল খাঁ, উলুবেড়িয়াতে পাপিয়া অধিকারী, উস্তিতে গিয়াসুদ্দিন মোল্লা, ময়নাতে অশোক ডিন্ডা, তমলুকে হরেকৃষ্ণ বেরা, খেজুরিতে পার্থপ্রতিম দাস, ফলতার বিধান পাড়ুই, নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারী-সহ নানা দলের প্রার্থীরা নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে আক্রান্ত, প্রহৃত হইয়াছেন। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিংসাত্মক পরিবেশে বুথে আটকাইয়া পড়িয়াছিলেন। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের গাড়ি ভাঙচুর হইয়াছে। নির্বাচন জিতিবার কৌশল হিসাবে হিংসার ব্যবহারে সব দল নির্লজ্জ, বেপরোয়া। যাহারা মহাপুরুষদের লইয়া অবিরাম আস্ফালন করে কিন্তু একে অপরের সহিত উন্মত্ত দুর্বৃত্তসম আচরণ করে, তাহারাই বাঙালি— দেশের নিকট রাজ্যবাসীর এই স্বরূপ আজ উন্মোচিত। আগামী পাঁচ দফাতেও যদি এমন বলোদ্ধত, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, সৌজন্যহীন, মানবতাবর্জিত ব্যবহার দেখা দেয়, তবে বাঙালির কলঙ্ক অনপনেয় হইবে, সন্দেহ নাই। নির্বাচনকালে হিংসার ঘটনাগুলিকে কোনও ভাবেই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলিয়া দেখা চলে না। এগুলি ব্যাপক ভাবে ঘটিয়াছে, এবং সকল পক্ষের সমান সমর্থন পাইয়াছে। অন্তত দশ জন রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক প্রাণ হারাইয়াছেন। এই ভাবেই জাতীয় রাজনীতিতে স্বাক্ষর রাখিতেছে পশ্চিমবঙ্গ।
এই নির্বাচনী হিংসা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু অপ্রত্যাশিত নহে। এমন হইবে, তাহা প্রত্যাশা করিয়াই এই রাজ্যে আট দফায় ভোট করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছিল নির্বাচন কমিশন। পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হইয়াছে রাজ্যে, রাজ্য পুলিশ ও প্রশাসনের কয়েক ডজন শীর্ষ কর্তাকে সরাইয়াছে কমিশন, রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ করিয়াছে, গোলমালের সম্ভাবনা দেখিলে আগাম ১৪৪ ধারা জারি করিয়াছে। সকলই তবে ভস্মে ঘি? প্রার্থীর উপর হামলা, ভোটারদের ভীতিপ্রদর্শন, বুথের বাহিরে সংঘর্ষ, রাজনৈতিক কর্মীদের খুন, কিছুই বাহিনীর আটকাইবার সাধ্য নাই? অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনা যদি লক্ষ্য হইয়া থাকে, তবে প্রথম তিন দফায় নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। নিরপেক্ষতার সূত্রও লঙ্ঘিত হইয়াছে ক্ষেত্রবিশেষে, এমনই অভিযোগ। রাজনৈতিক দলনেতাদের ব্যর্থতাও বিরাট। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং জনসভায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরিয়া রাখিবার, কেহ ‘দুষ্টুমি’ করিলে তাহাকে ‘শাসন’ করিবার পরামর্শ দিয়াছেন অনুগামীদের। প্রশাসনের শীর্ষ কর্তার ইহাই উপযুক্ত পরামর্শ বটে! অপর দিকে, বিজেপি দলটি ‘আসল পরিবর্তন’-এর ডাক দিবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি পদে বুঝাইয়া দিতেছে চিরপরিচিত রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পথেই সে হাঁটিবে, কোনও পরিবর্তনের প্রশ্নই নাই।
এই ক্ষমতালোলুপ, জিঘাংসু, আত্মঘাতী রাজনীতিই কি বাংলার প্রকৃত পরিচয়? ভুলিলে চলিবে না, হিংসার এমন আবহেও আশি শতাংশের উপর রাজ্যবাসী বুথে আসিয়া ভোট দিয়াছেন। ভয়, প্রলোভন, কিছুই তাঁহাদের ঘরবন্দি করিতে পারে নাই। নেতা-কর্মীরা যখন বাহিরে তাণ্ডব করিয়াছেন, তখনও বাংলার মানুষ শৃঙ্খলার সহিত ভোট দিয়াছেন, ইহাও বাংলারই সংস্কৃতি। তাঁহাদের ধৈর্যচ্যুতি হয় নাই, সাহসের অভাবও হয় নাই। দায়িত্ববান ভোটারের নীরব কর্তব্যপরায়ণতাতেই গণতন্ত্রের যথার্থ প্রকাশ। ইহা হইতে শিক্ষা লইতে হইবে নেতাদের। নির্বাচন কমিশনকেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy