—প্রতীকী চিত্র।
শেষ পর্যন্ত তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বীকার করল, রাজ্যে ডেঙ্গি রোগী ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রশাসনিক জরুরি বৈঠকে তা স্পষ্ট হল। প্রায় প্রতি বছরের মতো এই বছরেও ডেঙ্গিপ্রবণ জেলা হিসাবে দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহের নাম উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গি সংক্রমণ অত্যধিক বৃদ্ধির কারণে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিকেও বাড়তি সতর্ক করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত পতঙ্গনাশক গতিবিধি বাড়াতে বলা হয়েছে। এ সকলই সংক্রমণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ, তদর্থে জরুরিও। কিন্তু ডেঙ্গির মতো পতঙ্গবাহিত রোগ, যা প্রতি বছর প্রশাসনিক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাকে সফল ভাবে প্রতিরোধ করতে শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণের কাজটি যে যথেষ্ট নয়, তা এত দিনের অভিজ্ঞতাও রাজ্য প্রশাসনকে শেখাতে পারল না, এটাই আশ্চর্যের।
ডেঙ্গি নিয়ে কুনাট্য যেন প্রতি বছর এই রাজ্যে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক অল্পবয়সি, কর্মক্ষমরা এই রোগের শিকার, অথচ এত বছরেও কোনও সুসংহত, সক্রিয় কর্মী-বাহিনী গড়ে তোলা গেল না, যাঁরা সারা বছর তৎপরতার সঙ্গে রোগ প্রতিরোধের কাজটি করতে পারবেন। প্রতি বছর মৃত্যুমিছিল শুরু হলে তবে প্রশাসনের টনক নড়ে। আর কত প্রাণের বিনিময়ে বোধগম্য হবে যে, উপযুক্ত দীর্ঘ প্রস্তুতি ছাড়া আপৎকালীন ভিত্তিতে ডেঙ্গির মতো সংক্রামক রোগের মোকাবিলা সম্ভব নয়? ২০১৮ সালে ডেঙ্গির ভয়াবহ সংক্রমণের পর শহরাঞ্চলে ওয়র্ড-পিছু পতঙ্গবিদ, প্রশিক্ষিত কর্মী-সহ বাহিনী গড়ে তোলার কথা আলোচিত হয়েছিল। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত। সেই কাজ কত দূর এগিয়েছে? সত্যিই প্রশাসন সেই কাজে উদ্যোগী হলে বরাবরের মতো নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে ফের সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত দেখা যেত কি? প্রতি বছর ডেঙ্গি সংক্রমণ তুঙ্গে উঠলে সরকারের তরফ থেকে জনগণের অ-সচেতনতার কথা জোর দিয়ে বলা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র জনগণের অ-সচেতনতা দিয়ে পুর-প্রশাসনের ব্যর্থতা চাপা পড়ে না। ফুলদানি, টব আর চৌবাচ্চার জলে লার্ভা খোঁজার পাশাপাশি পরিত্যক্ত জমিতে জমা আবর্জনা, বেহাল নিকাশি এবং থানার সামনে পরিত্যক্ত গাড়িতে জল জমার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তা অনেকাংশেই হয়নি।
তদুপরি রয়েছে সরকারের তরফে তথ্যগোপনের ভয়ঙ্কর মানসিকতা। জনস্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক— এমন যে কোনও রোগে উপযুক্ত তথ্য-পরিসংখ্যান রোগের চরিত্র নির্ধারণ-সহ নানা জরুরি বিষয় সামনে আনে। তথ্যে অস্পষ্টতা বিপদের গুরুত্বকে নাগরিক চোখে লঘু করে তোলে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে পারেন না। অথচ এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের কার্পণ্য এবং নীরবতা চোখে পড়ার মতো। সরকারি সূত্রে শুধুমাত্র জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে দেড় হাজার ডেঙ্গি রোগী ভর্তি আছেন এবং তাঁদের মধ্যে ২৫ জনের অবস্থা গুরুতর। কিন্তু হাসপাতালের সীমানার বাইরে যে বিরাট সংখ্যক মানুষ এ বছরের জানুয়ারি থেকে সংক্রমিত হয়েছেন সেই সংখ্যাটি কত, কত জনই বা মারা গিয়েছেন— সে বিষয়ে কুলুপ এঁটেছেন সরকারি কর্তারা। তথ্য ফাঁস হলে সিআইডি তদন্তের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। কর্তাদের আচরণ দেখে মনে হয়, ডেঙ্গির বাৎসরিক সংক্রমণ বৃদ্ধি, এবং মৃত্যুর ঘটনা যেন স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। অথচ, গোড়া থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করলে এই রোগকে আটকে দেওয়া সম্ভব, তা ইতিপূর্বে দেখা গিয়েছে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীও ডেঙ্গি নিয়ে একাধিক বার প্রথম থেকে সতর্ক হওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন। তৎসত্ত্বেও যে প্রতি বছর সংক্রমণ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করতে হচ্ছে এবং মৃত্যু ঠেকাতে নাগরিককে মশার সুবুদ্ধি প্রার্থনা করতে হচ্ছে— সেই লজ্জা রাজ্য প্রশাসন রাখবে কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy